ঢাকা , শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫, ১৩ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম :

রোজার আগেই জাতীয় নির্বাচন

সাংবাদিক

বৈঠকটা শুরু হয়েছিল হাসিমুখে, যার শেষও হয় সেই হাসিতে। সবার মুখে বিজয়ের শেষ হাসি। প্রত্যাশিত সমঝোতায় সফল হলো প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বহুল আলোচিত শুক্রবারের লন্ডন বৈঠক। বৈঠক শেষে দুই পক্ষের যৌথ বিবৃতি ও ব্রিফিং বলে দিচ্ছে সবাই জিতেছে। হারেনি কেউ। জয় হয়েছে বাংলাদেশের। শেষ হলো টানটান উত্তেজনার। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল পুরো জাতি। অবসান হলো সব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার। জাতীয় নির্বাচন রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেই হচ্ছে। বিস্তারিত ঘোষণাটা আসবে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে।

এদিকে ঐতিহাসিক এ বৈঠক থেকে দেশের স্বার্থে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে জীবন বিসর্জন দেওয়া জাতীয় বীরদের প্রতি। একইভাবে স্মরণ করা হয়েছে কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের জন্য যারা বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জীবনদানসহ নানাভাবে ত্যাগ স্বীকার করেছেন-তাদের প্রতি। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে। বৈঠক শেষে ব্রিফিং থেকে আরও বলা হয়, সংস্কার ও বিচার একটি চলমান প্রক্রিয়া। নির্বাচনের আগে ও পরেও এটি অব্যাহত থাকবে। বৈঠকের আলোচনা ও সার্থকতা নিয়ে উভয় পক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে বিএনপি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, বৈঠক সফল, জাতিকে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখালেন দুই নেতা। এছাড়া দু-একটি রাজনৈতিক দল ছাড়া সব দলই বৈঠককে ইতিবাচক আখ্যা দিয়ে বলেছে, নির্বাচন নিয়ে আর কোনো সংকট নেই, সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটও কেটে গেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কারও কারও কাছে এই সমঝোতা ও সিদ্ধান্ত ভালো নাও লাগতে পারে। বিশেষ করে যারা গণ-অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্র বানাতে মরিয়া, তাদের জন্য এটি অবশ্যই মন খারাপের সংবাদ। যারা নানা কৌশলে ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসন করতে চায়, তারাও বিষয়টিকে ভালোভাবে নেবে না। এছাড়া নির্বাচনের মাধ্যমে জয়লাভ করে যারা কাঙ্ক্ষিত আসন পাবে না বলে নিশ্চিত, তারাও সমালোচনা করাসহ নানাভাবে দড়ি টানাটানি করতেই থাকবে। তবে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী ১০ মাসে যে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার ও সফলতা অর্জিত হয়নি, তার জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা না করে দেশপ্রেমিক সবার উচিত হবে, আগে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের হাত থেকে দেশটাকে বাঁচানো।

গত বছরের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এটি অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে প্রথম বৈঠক। বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টার দিকে (স্থানীয় সময় সকাল ৮টা) কিংস্টন এলাকার নিজের বাসা থেকে দেশটির রাজধানী লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলের উদ্দেশে বের হন হন তারেক রহমান। হোটেলের সামনে তার গাড়িবহর এলে সেখানে আগেই অবস্থান নেওয়া হাজারো বিএনপি নেতাকর্মী তাকে স্বাগত জানান। এ সময় তারেক রহমান হাত নাড়িয়ে নেতাকর্মীদের প্রতি শুভেচ্ছা জানান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বৈঠকের নির্ধারিত সময় দুপুর ২টার (স্থানীয় সময় সকাল ৯টা) কিছু আগে তারেক রহমান হোটেলের সামনে পৌঁছান। তাকে অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার আকবর হোসেন স্বাগত জানান। পরে তারেক রহমানকে হোটেলের ভেতরে নির্ধারিত কক্ষের দিকে নিয়ে যান তারা। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা কক্ষের সামনে থেকে তারেক রহমানকে এগিয়ে নিয়ে যান। আলোচনা কক্ষে প্রবেশের সময় তারেক রহমান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ তার সঙ্গে আসা অন্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর প্রধান উপদেষ্টা ও তারেক রহমান হাসিমুখে করমর্দন করেন। প্রধান উপদেষ্টা তারেক রহমানকে বলেন, খুব ভালো লাগছে। তারেক রহমানও বলেন, আমার কাছেও খুব ভালো লাগছে। আপনার শরীর কেমন? উত্তরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, চলছে, টাইনাটুইনা চলতে হয়। এ সময় তারেক রহমান বলেন, আম্মা (বেগম খালেদা জিয়া) আপনাকে সালাম জানিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, উনি অসাধারণ মানুষ, অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

অতঃপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। নির্ধারিত সময় ঠিক দুপুর ২টায় বৈঠক শুরু হয়। প্রথমে কিছুক্ষণ দুই সাইডের ডেলিগেশনের (প্রতিনিধিদল) সঙ্গে বৈঠক হয়। পরে দীর্ঘ সময় ধরে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের ‘ওয়ান টু ওয়ান’ আলোচনা হয়। দেড় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক শেষে ডরচেস্টার হোটেল থেকে তারেক রহমানকে হাসিমুখে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। এর আগে বৈঠক কক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসও হাসিমুখে তারেক রহমানকে বিদায় জানান।

যা বলা হয় যৌথ বিবৃতিতে : বৈঠক শেষে দুই পক্ষ থেকে একটি যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার কাছে আগামী বছরের রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তাব করেন। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও মনে করেন, ওই সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভালো হয়। প্রধান উপদেষ্টা বলেন যে, তিনি আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার এ অবস্থানকে স্বাগত জানান এবং দলের পক্ষ থেকে তাকে ধন্যবাদ জানান। প্রধান উপদেষ্টাও তারেক রহমানকে ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য ধন্যবাদ জানান।

দুই পক্ষেরই সন্তুষ্টি প্রকাশ : প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেড় ঘণ্টার বৈঠক শেষে দুই পক্ষের প্রতিনিধিরা তাদের সন্তুষ্টির কথা জানান। বৈঠক-পরবর্তী যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বৈঠকের আলোচনায় তারা সন্তুষ্ট হয়েছেন। বিকাল চারটার দিকে ওই হোটেলেই যৌথ সংবাদ সম্মেলন হয়। সেখানে কথা বলেন খলিলুর রহমান ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন। নির্বাচনের তারিখ নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, সঠিক তারিখ নির্ধারণে আমরা কোনো সমস্যা দেখছি না। কেউ দেখলে তা ভুল দেখছেন। নির্বাচন কমিশন শিগগিরই একটা তারিখ ঘোষণা করবে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘জুলাই সনদ নিয়ে আলোচনা চলছে। এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত আসছে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ হবে। সংস্কারের ব্যাপারেও একই, ঐকমত্যের পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কারও করব। আমি নিশ্চিত খুব কম সময়ের মধ্যে সেই সিদ্ধান্ত দিতে পারব। স্বাভাবিকভাবে ঐকমত্যের পরিপ্রেক্ষিতে যে সিদ্ধান্ত হবে, স্বাক্ষর তো হবেই, না হওয়ার তো কোনো কারণ নেই।

সব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে আমির খসরু বলেন, নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছি। সবাই চায় দেশ গড়ার যে প্রত্যয় আমরা নিয়েছি, ঐক্যবদ্ধভাবে সেই কাজটি করব। শুধু নির্বাচনের আগে নয়, নির্বাচনের পরেও বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে আমরা যে সবাই ঐকমত্য হয়েছি, তা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব।

সংস্কার প্রসঙ্গে আরেক প্রশ্নের জবাবে আমির খসরু বলেন, এটা তো পরিষ্কার। এখানে না বোঝার কোনো কারণ নেই। সংস্কার নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা, তারেক রহমান-আমরা সবাই একই কথা বলেছি, যে বিষয়গুলোতে ঐকমত্য হবে সেগুলোই সংস্কার হবে। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এমন নয় যে, আজ সব সংস্কার শেষ হয়ে যাবে। নির্বাচনের আগেও ঐকমত্যের ভিত্তিতে কিছু সংস্কার হবে, নির্বাচনের পরেও সংস্কার অব্যাহত থাকবে। কারণ আমরা যে দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়েছি, সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সবাই অনুভব করছি। সুতরাং আগে-পরে সংস্কার চলতে থাকবে।

তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে আমির খসরু বলেন, এ ব্যাপারে আলোচনার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমরা মনে করি না। তারেক রহমান যখন ইচ্ছা, উনি দেশে ফিরে যেতে পারবেন। সুতরাং সময়মতো এ বিষয়ে উনি সিদ্ধান্ত নেবেন।

বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, সংস্কার ও বিচার-দুই বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতির কথা বলা হয়েছে। আমরা মোটামুটি কনফিডেন্ট এই অগ্রগতি নির্বাচনের আগেই দেখতে পারব। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা সবাইকে নিয়েই নির্বাচনে যেতে চাই।

তারেক রহমানের উপহার : প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কলম ও বই উপহার দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এই উপহারের ছবি পোস্ট করেন। শফিকুল আলমের পোস্টে দেখা গেছে, তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টাকে একটি কলম ও দুটি বই উপহার দিয়েছেন। একটি বই হলো পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গের ‘নো ওয়ান ইস টু স্মল টু মেক অ্যা ডিফারেন্স।’ আরেকটি বই ‘নেচার ম্যাটারস’।

সূত্রঃ যুগান্তর

ট্যাগ :

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

আপডেটের সময় : ০৩:২৩:০৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫
৫২৯ Time View

রোজার আগেই জাতীয় নির্বাচন

আপডেটের সময় : ০৩:২৩:০৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫

বৈঠকটা শুরু হয়েছিল হাসিমুখে, যার শেষও হয় সেই হাসিতে। সবার মুখে বিজয়ের শেষ হাসি। প্রত্যাশিত সমঝোতায় সফল হলো প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বহুল আলোচিত শুক্রবারের লন্ডন বৈঠক। বৈঠক শেষে দুই পক্ষের যৌথ বিবৃতি ও ব্রিফিং বলে দিচ্ছে সবাই জিতেছে। হারেনি কেউ। জয় হয়েছে বাংলাদেশের। শেষ হলো টানটান উত্তেজনার। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল পুরো জাতি। অবসান হলো সব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার। জাতীয় নির্বাচন রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেই হচ্ছে। বিস্তারিত ঘোষণাটা আসবে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে।

এদিকে ঐতিহাসিক এ বৈঠক থেকে দেশের স্বার্থে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে জীবন বিসর্জন দেওয়া জাতীয় বীরদের প্রতি। একইভাবে স্মরণ করা হয়েছে কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের জন্য যারা বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জীবনদানসহ নানাভাবে ত্যাগ স্বীকার করেছেন-তাদের প্রতি। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে। বৈঠক শেষে ব্রিফিং থেকে আরও বলা হয়, সংস্কার ও বিচার একটি চলমান প্রক্রিয়া। নির্বাচনের আগে ও পরেও এটি অব্যাহত থাকবে। বৈঠকের আলোচনা ও সার্থকতা নিয়ে উভয় পক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে বিএনপি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, বৈঠক সফল, জাতিকে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখালেন দুই নেতা। এছাড়া দু-একটি রাজনৈতিক দল ছাড়া সব দলই বৈঠককে ইতিবাচক আখ্যা দিয়ে বলেছে, নির্বাচন নিয়ে আর কোনো সংকট নেই, সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটও কেটে গেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কারও কারও কাছে এই সমঝোতা ও সিদ্ধান্ত ভালো নাও লাগতে পারে। বিশেষ করে যারা গণ-অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্র বানাতে মরিয়া, তাদের জন্য এটি অবশ্যই মন খারাপের সংবাদ। যারা নানা কৌশলে ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসন করতে চায়, তারাও বিষয়টিকে ভালোভাবে নেবে না। এছাড়া নির্বাচনের মাধ্যমে জয়লাভ করে যারা কাঙ্ক্ষিত আসন পাবে না বলে নিশ্চিত, তারাও সমালোচনা করাসহ নানাভাবে দড়ি টানাটানি করতেই থাকবে। তবে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী ১০ মাসে যে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার ও সফলতা অর্জিত হয়নি, তার জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা না করে দেশপ্রেমিক সবার উচিত হবে, আগে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের হাত থেকে দেশটাকে বাঁচানো।

গত বছরের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এটি অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে প্রথম বৈঠক। বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টার দিকে (স্থানীয় সময় সকাল ৮টা) কিংস্টন এলাকার নিজের বাসা থেকে দেশটির রাজধানী লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলের উদ্দেশে বের হন হন তারেক রহমান। হোটেলের সামনে তার গাড়িবহর এলে সেখানে আগেই অবস্থান নেওয়া হাজারো বিএনপি নেতাকর্মী তাকে স্বাগত জানান। এ সময় তারেক রহমান হাত নাড়িয়ে নেতাকর্মীদের প্রতি শুভেচ্ছা জানান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বৈঠকের নির্ধারিত সময় দুপুর ২টার (স্থানীয় সময় সকাল ৯টা) কিছু আগে তারেক রহমান হোটেলের সামনে পৌঁছান। তাকে অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার আকবর হোসেন স্বাগত জানান। পরে তারেক রহমানকে হোটেলের ভেতরে নির্ধারিত কক্ষের দিকে নিয়ে যান তারা। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা কক্ষের সামনে থেকে তারেক রহমানকে এগিয়ে নিয়ে যান। আলোচনা কক্ষে প্রবেশের সময় তারেক রহমান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ তার সঙ্গে আসা অন্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর প্রধান উপদেষ্টা ও তারেক রহমান হাসিমুখে করমর্দন করেন। প্রধান উপদেষ্টা তারেক রহমানকে বলেন, খুব ভালো লাগছে। তারেক রহমানও বলেন, আমার কাছেও খুব ভালো লাগছে। আপনার শরীর কেমন? উত্তরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, চলছে, টাইনাটুইনা চলতে হয়। এ সময় তারেক রহমান বলেন, আম্মা (বেগম খালেদা জিয়া) আপনাকে সালাম জানিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, উনি অসাধারণ মানুষ, অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

অতঃপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। নির্ধারিত সময় ঠিক দুপুর ২টায় বৈঠক শুরু হয়। প্রথমে কিছুক্ষণ দুই সাইডের ডেলিগেশনের (প্রতিনিধিদল) সঙ্গে বৈঠক হয়। পরে দীর্ঘ সময় ধরে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের ‘ওয়ান টু ওয়ান’ আলোচনা হয়। দেড় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক শেষে ডরচেস্টার হোটেল থেকে তারেক রহমানকে হাসিমুখে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। এর আগে বৈঠক কক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসও হাসিমুখে তারেক রহমানকে বিদায় জানান।

যা বলা হয় যৌথ বিবৃতিতে : বৈঠক শেষে দুই পক্ষ থেকে একটি যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার কাছে আগামী বছরের রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তাব করেন। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও মনে করেন, ওই সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভালো হয়। প্রধান উপদেষ্টা বলেন যে, তিনি আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার এ অবস্থানকে স্বাগত জানান এবং দলের পক্ষ থেকে তাকে ধন্যবাদ জানান। প্রধান উপদেষ্টাও তারেক রহমানকে ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য ধন্যবাদ জানান।

দুই পক্ষেরই সন্তুষ্টি প্রকাশ : প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেড় ঘণ্টার বৈঠক শেষে দুই পক্ষের প্রতিনিধিরা তাদের সন্তুষ্টির কথা জানান। বৈঠক-পরবর্তী যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বৈঠকের আলোচনায় তারা সন্তুষ্ট হয়েছেন। বিকাল চারটার দিকে ওই হোটেলেই যৌথ সংবাদ সম্মেলন হয়। সেখানে কথা বলেন খলিলুর রহমান ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন। নির্বাচনের তারিখ নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, সঠিক তারিখ নির্ধারণে আমরা কোনো সমস্যা দেখছি না। কেউ দেখলে তা ভুল দেখছেন। নির্বাচন কমিশন শিগগিরই একটা তারিখ ঘোষণা করবে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘জুলাই সনদ নিয়ে আলোচনা চলছে। এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত আসছে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ হবে। সংস্কারের ব্যাপারেও একই, ঐকমত্যের পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কারও করব। আমি নিশ্চিত খুব কম সময়ের মধ্যে সেই সিদ্ধান্ত দিতে পারব। স্বাভাবিকভাবে ঐকমত্যের পরিপ্রেক্ষিতে যে সিদ্ধান্ত হবে, স্বাক্ষর তো হবেই, না হওয়ার তো কোনো কারণ নেই।

সব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে আমির খসরু বলেন, নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছি। সবাই চায় দেশ গড়ার যে প্রত্যয় আমরা নিয়েছি, ঐক্যবদ্ধভাবে সেই কাজটি করব। শুধু নির্বাচনের আগে নয়, নির্বাচনের পরেও বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে আমরা যে সবাই ঐকমত্য হয়েছি, তা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব।

সংস্কার প্রসঙ্গে আরেক প্রশ্নের জবাবে আমির খসরু বলেন, এটা তো পরিষ্কার। এখানে না বোঝার কোনো কারণ নেই। সংস্কার নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা, তারেক রহমান-আমরা সবাই একই কথা বলেছি, যে বিষয়গুলোতে ঐকমত্য হবে সেগুলোই সংস্কার হবে। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এমন নয় যে, আজ সব সংস্কার শেষ হয়ে যাবে। নির্বাচনের আগেও ঐকমত্যের ভিত্তিতে কিছু সংস্কার হবে, নির্বাচনের পরেও সংস্কার অব্যাহত থাকবে। কারণ আমরা যে দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়েছি, সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সবাই অনুভব করছি। সুতরাং আগে-পরে সংস্কার চলতে থাকবে।

তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে আমির খসরু বলেন, এ ব্যাপারে আলোচনার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমরা মনে করি না। তারেক রহমান যখন ইচ্ছা, উনি দেশে ফিরে যেতে পারবেন। সুতরাং সময়মতো এ বিষয়ে উনি সিদ্ধান্ত নেবেন।

বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, সংস্কার ও বিচার-দুই বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতির কথা বলা হয়েছে। আমরা মোটামুটি কনফিডেন্ট এই অগ্রগতি নির্বাচনের আগেই দেখতে পারব। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা সবাইকে নিয়েই নির্বাচনে যেতে চাই।

তারেক রহমানের উপহার : প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কলম ও বই উপহার দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এই উপহারের ছবি পোস্ট করেন। শফিকুল আলমের পোস্টে দেখা গেছে, তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টাকে একটি কলম ও দুটি বই উপহার দিয়েছেন। একটি বই হলো পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গের ‘নো ওয়ান ইস টু স্মল টু মেক অ্যা ডিফারেন্স।’ আরেকটি বই ‘নেচার ম্যাটারস’।

সূত্রঃ যুগান্তর