আমরা জানি, একজন মানুষ জন্মের পরপরই হঠাৎ করে শিক্ষিত হয়ে যায় না, শিক্ষাজীবনের অনেকগুলো ধাপ তাকে অতিক্রম করতে হয়। মূলত ছোটবেলায় একটি শিশুর মা-বাবার কাছেই শিক্ষার হাতেখড়ি হয়। তারপর এক এক করে স্কুল বা মাদ্রাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হতে হয়। তবে শিক্ষা অর্জনের এই ধাপগুলো অতিক্রম করা একেবারেই সহজ কিংবা মসৃণ নয়। পর্যায়ক্রমে ধাপগুলো সহজ থেকে কঠিন, কঠিন থেকে কঠিনতর হতে থাকে। ছোটবেলায় একজন শিক্ষার্থীকে বলা যায় হাতে ধরে ধরে সবকিছু শেখাতে হয়, অনেক দিক-নির্দেশনা দিতে হয়, কিন্তু বয়স ও জ্ঞান-বুদ্ধি বাড়ার সাথে সাথে নিজে নিজেই অনেক কিছু করতে পারে, বুঝতে পারে। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা সাজাতে পারে। তবে একজন শিক্ষার্থীকে বয়স অনুপাতে মা-বাবা বা শিক্ষকরা গাইড করুক অথবা নিজেকে নিজে গাইড করুক, যাই হোক না কেন, তার পথচলাটা অবশ্যই সঠিক পথে হতে হবে, যদি উচ্চ শিক্ষা অর্জনের পরিকল্পনা তার থাকে। তবেই শিক্ষাজীবনের ধাপগুলো অতিক্রম করা তার পক্ষে সহজ হবে।
আমাদের অধিকাংশ অভিভাবক কিংবা শিক্ষক-শিক্ষিকা আমাদের শিক্ষার্থী বা সন্তানদেরকে তাদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করার বিষয়ে সঠিক সময়ে সঠিক দিক-নির্দেশনা দিতে পারেন না। জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ বা লক্ষ্যে পৌঁছাতে প্রয়োজনীয় উৎসাহ যোগাতে পারেন না। এ ব্যর্থতা অনস্বীকার্য। যার ফলে আমাদের অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবনে ভালোভাবে বেশিদূর এগুতে পারেন না। আমি আমার একটি লেখায় বলেছিলাম, ‘একজন শিক্ষার্থীকে শিক্ষিত বা সুশিক্ষিত করার ক্ষেত্রে তার নিজের দায়িত্বশীল কর্মকাণ্ড মুখ্য ভুমিকা পালন করে।’ তবে একথাটি মূলত একটু পরিণত বয়সের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেই বেশি প্রযোজ্য। কিন্তু যাদের বয়স কম বা অপরিণত তাদের ক্ষেত্রে অবশ্যই উপযুক্ত সময়ে সঠিক দিক-নির্দেশনা অপরিহার্য। ছোটবেলায় একজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে মা-বাবা ও শিক্ষক-শিক্ষিকাকে যে পরিমাণ কষ্ট করতে হয় বয়স বাড়ার সাথে সাথে এতটা কষ্ট করতে হয় না! তবে এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, আমরা আমাদের সন্তান বা শিক্ষার্থীদেরকে কোন বয়সে কোন ধরনের অনুপ্রেরণা এবং দিক-নির্দেশনা দেওয়া দরকার সেটি আমরা অনেকে ভালোভাবে বুঝি না, সেজন্য তাদেরকেও যথাসময়ে সঠিকভাবে তা দিতে পারি না। একারণে সামগ্রিক অর্থে বলা যায় আমাদের মধ্যে শিক্ষার সকল ধাপেই লক্ষ্যহীন শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি!
এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে চাই, সম্প্রতি আমি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনকালে বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদেরকে লেখাপড়া করার উদ্দেশ্য বা তাদের জীবনের লক্ষ্য কী এই প্রশ্নটি করেছি। আমার মতো এজাতীয় প্রশ্ন সাধারণত অনেকেই অকপটে করে থাকেন! কিন্তু বিশ্বাস করুন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই প্রশ্নের উত্তরে আমি হতাশ হয়েছি। তাদের বেশিরভাগই এই প্রশ্নের সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারেনি। তারা বুঝে হোক কিংবা না বুঝে হোক, মুখস্থ বিদ্যা থেকে হোক একটা উত্তর দিতে পারলেই মনে হয় বেঁচে যায়। অনেকে বই-পুস্তকে পড়া উত্তরটি সাবলীলভাবে দিয়ে দেন। যেটি হয়তো তার মনের কথা নয় বা তার নিজস্ব লক্ষ্য কিংবা ইচ্ছার প্রতিফলন নয়! অনেকে এখনো কোন লক্ষ্যই সেট করেনি। আবার অনেকের লক্ষ্য ভালো রেজাল্ট করা, অনেকে কলেজে ভর্তি হবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন ইত্যাদি। তবে অনেক শিক্ষার্থীকে আমরা বয়স ও শিক্ষা বিবেচনা না করেই এই প্রশ্নটি করে থাকি। যার ফলে তাদের কাছ থেকে সদুত্তর পাওয়া যায় না। কারণ অনেকে এই উত্তরটি দেওয়ার জন্য যথেষ্ট পরিণত নয়!
কমবয়সী অন্যান্য শিক্ষার্থীদের কথা বাদ দিলাম। আমরা যদি অন্তত নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদেরকে তাদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে সঠিক দিক-নির্দেশনা দিতে না পারি, আমরা যদি তাদেরকে না বলি কিংবা বুঝাতে ব্যর্থ হই যে, “আগামীতে তোমাদেরকেই এই দেশ চালাতে হবে। তোমরাই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার, শিক্ষক, গবেষক, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা প্রভৃতি হয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করতে হবে, অবদান রাখতে হবে। আজ যারা এসব জায়গায় আছেন, বর্তমানে যারা দেশ চালাচ্ছেন বয়সের কারণে এবং প্রকৃতির নিয়ম মেনে পর্যায়ক্রমে তারা সরে যাবেন, তোমরাই তাদের স্থান পূরণ করবে। আর এজন্য তোমাদেরকে অবশ্যই প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। তোমাদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে সঠিক কর্মকৌশল ঠিক করে সামনে এগুতে হবে। তবেই তোমরা সহজে লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে।” তাহলে তারা কীভাবে জীবনের লক্ষ্য ঠিক করবেন এবং লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা চালাবেন?
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার আগেই আমার সহপাঠীরা ঢাকার রাস্তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস দেখলেই আমাকে বলতো, ‘কয়েকদিন পর তুমিও এই গাড়িতে চড়বে’। তখন সহপাঠীদের কথাকে একটু বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিলো কিংবা কখনো কখনো মনে করতাম ওরা কি আমার সাথে মজা নিচ্ছে কি না? কিন্তু না। পরে বুঝলাম, তারা আমার সাথে মজা করেনি। তারা সত্যিই এমনটা বিশ্বাস করতে পেরেছিলো। তাই এভাবে বলেছিলো। মূলত আমার সার্বিক পড়াশুনা ও প্রস্তুতি মূল্যায়নে তাদের এমনই ধারণা জন্মেছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, বুয়েট ইত্যাদি শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হতে উচ্চশিক্ষা অর্জনের স্বপ্ন নিশ্চয়ই অনেক শিক্ষার্থীই দেখেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তারা সেই স্বপ্নপূরণ বা লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য যে পরিমাণ পড়াশুনা কিংবা প্রস্তুতি প্রয়োজন তা গ্রহণ করছে কি না? তারা কি জানে- কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে তাদেরকে কোন পথগুলো পাড়ি দিতে হবে? কীভাবে পাড়ি দিতে হবে? কোন কোন কৌশল অবলম্বন করতে হবে? যদি জানে, তবে ভালো। আর যদি না জানে, তবে তাদেরকে উপযুক্ত সময়ে ও সঠিক বয়সে অবশ্যই জানাতে হবে।
লেখক:
শরীফ উল্যাহ
উপজেলা নির্বাহী অফিসার
লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।