দেশে চলমান সংকট মোকাবেলায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারসহ ছয় মাসের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক প্যাকেজ গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ।
শুক্রবার (১২ আগস্ট) সকালে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির জরুরি সভায় এই প্যাকেজ প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও স্থায়ী কমিটির সদস্য শিরীন আখতার এমপি, কার্যকরী সভাপতি ও স্থায়ী কমিটির সদস্য এড. রবিউল আলম, আফরোজা হক রীনা, আব্দুল্লাহিল কাইয়ূম, শওকত রায়হান, রোকনুজ্জামান রোকন ও ওবায়দুর রহমান চুন্নু
সভায় গৃহিত রাজনৈতিক প্রস্তাব:
জাসদ মনে করে, দুই বছরের অধিককালের বৈশ্বিক মহামারি করোনার অভিঘাত কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অপরিণামদর্শী নিষেধাজ্ঞা জারির ফলে খাদ্যশস্য, জ্বলানি, খাদ্যদ্রব্য, নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের আন্তর্জাতিক বাজার ও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে পৃথিবীর প্রতিটি দেশের মত বাংলাদেশের মানুষের জীবনেও সংকট ও দুর্ভোগ বেড়েছে।
বৈশ্বিক মহামারি করোনা মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার বাস্তবসম্মত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে জীবন ও জীবিকার ভারসাম্য বজায় রেখে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন অব্যাহত রাখা, সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর রাখা, অসহায়-নিরুপায়-আয়হীন-কর্মহীন মানুষকে নগদ অর্থ-খাদ্য-ত্রাণ ও বিনামূল্যে ভ্যাকসিন প্রদান করে জাতীয় নেতৃত্ব ও জাতীয় অর্থনীতির সক্ষমতা প্রদর্শণ করেছে।
জাসদ মনে করে, আন্তর্জাতিক সংকট বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে বর্তমানে যে বাড়তি চাপ তৈরি করেছে সেটা মোকাবেলা করা সম্ভব এবং এই সক্ষমতা জাতীয় অর্থনীতির আছে। করোনা মোকাবেলায় জাতীয় অর্থনীতি সেই সক্ষমতা প্রদর্শণ করেছে। বর্তমান সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজন অস্থিরতা ও দিশেহারা ভাব পরিহার করা। সরকার ও প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও বিশৃঙ্খলা দূর করা।
জাসদ মনে করে, বর্তমান সংকটের প্রকৃত হিসাব-নিকাশ, সমীক্ষা, চিত্র এবং এগুলোর সমাধানের বাস্তব ও যৌক্তিক পথ ও উপায় কি- তা সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের সামনে সুস্পষ্ট, স্বচ্ছ ও সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা হয়নি। বরং সরকার ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের কথাবার্তায় অস্থিরতা, দিশেহারাভাব, সমন্বয়হীনতা ও বিশৃঙ্খলারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। গণমাধ্যমও সংকটের প্রকৃত চিত্র ও সমাধানের বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয় তুলে ধরার চেয়ে সংকটের ভয়াবহ পরিণতির আশংকাকেই ফলাও করে তুলে ধরছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ভূলতথ্য, অপতথ্য, আংশিক তথ্য, মিথ্যা প্রচার করে জনমনে আতংক তৈরি করা হচ্ছে। জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, বিশেষজ্ঞ হিসাবে পরিচিত ব্যক্তিরাও সংকট সমাধানের সুনির্দিষ্ট পথ দেখানোর বদলে সংকীর্ন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে একতরফা বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। আর বিএনপি-জামাতসহ কতিপয় দল সংকট সমাধানের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব না দিয়ে জনগণের দুর্ভোগ ও কষ্টকে পুঁজি করে সরকার উৎখাত ও ক্ষমতা দখলের জঘন্য অমানবিক রাজনীতি করছে।
বর্তমান সংকট মোকাবেলায় জাসদের প্রস্তাব:
বৈশ্বিক এ সংকটের মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতি সচল, কৃষি ও শিল্প উৎপাদন সচল, বিদ্যুৎ উৎপাদন সচল, নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা, সাধারণ মানুষের আয় ও জীবিকা ধরে রাখাই বাংলাদেশ সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ। বর্তমান বৈশ্বিক সংকটের ধাক্কা মোকাবেলায় এবং ভবিষ্যতের যে কোনো সংকট মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি আগামী ছয় মাসের জন্য সরকারকে বিশেষ অর্থনৈতিক প্যাকেজ গ্রহণ করতে হবে।
১.সরকারকে অস্থিরতা ও দিশেহারাভাব ঝেরে ফেলে বর্তমান সংকটের প্রকৃত হিসাব-নিকাশ, সমীক্ষা, চিত্র এবং এগুলোর সমাধানের বাস্তব ও যৌক্তিক পথ এবং উপায় সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের সামনে সুস্পষ্ট, স্বচ্ছ ও সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা।
২.আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য উঠানামায় অস্থির হয়ে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির এ সিদ্ধান্ত কৃষি ও শিল্প উৎপাদন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, জনপরিবহণ ও পণ্যপরিবহণসহ সামগ্রিক অর্থনীতির উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করেছে। ফলে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে রাজস্ব আয় সামান্য বাড়লেও সামগ্রিক অর্থনীতিতে সেই রাজস্ব আয়ের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণ বেশি। তাই আগামী ছয় মাসের জন্য জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে। জ্বালানি তেলের উপর বিদ্যমান শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার এবং প্রয়োজনে বাজেটের বিভিন্ন খাতের বরাদ্দ সমন্বয় করে জ্বালানি খাত, কৃষি খাত, সারের দাম কমাতে ভর্তুকি দিতে হবে।
৩.জ্বালানি খাত থেকে রাজস্ব আয় বাড়ানোর আত্মঘাতি পথ থেকে বেড়িয়ে আসার পশাপাশি রাজস্ব বাড়ানোর জন্য সম্পদের উপর সরাসরি কর বৃদ্ধি, কর-ভ্যাট আদায়ে অটোমেশন চালু, জাতীয় পরিচয়পত্র ও গণশুমারীর তথ্য ধরে করের আওতায় বহির্ভূত কর ফাঁকিদাতাদের চিহ্নিত করে করের আওতায় আনা, দেশের নয় লক্ষ হাট-বাজারের করের আওয়াতাভুক্ত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে করের আওয়াতায় আনতে হবে।
৪.বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বর্তমান বাস্তব চিত্র স্বচ্ছ ও সুস্পষ্টভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরে এ খাতে নীতি-কৌশলগত ভুল ত্রুটি, সমন্বয়হীনতা, অপচয়, অপ্রয়োজনীয় ব্যয়, অলাভজনক ব্যয়, পদ্ধতিগত লোকসান, দুর্নীতি, লুটপাটের যত অভিযোগ সামনে এসেছে সেগুলোর যৌক্তিক জবাব দিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নীতির পুনমূল্যায়ন করে পুননির্ধারণ করতে হবে। তার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে পুনর্গঠন করতে হবে।
৫.‘বিলাস দ্রব্য’, ‘অপ্রয়োজনীয় আমদানির সংজ্ঞা’ সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করে ডলার সহ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের ঘোষণা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন, ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় ও বিক্রয়ের প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক বাজারে যে বিশৃংখলা তৈরি হয়েছে তা কঠোরভাবে দূর করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর চাপ কমাতে হবে। রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়াতে রেমিটেন্সের উপর প্রদত্ত প্রণোদনা ২% থেকে ৩% -এ উন্নীত করতে হবে। ডলারের মূল্য নির্ধারণ খোলা বাজারের উপর ছেড়ে না দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণেই রাখতে হবে। প্রতিবেশী ও বন্ধু দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যে ডলারের বিকল্প হিসাবে দেশীয়/স্থানীয়/গ্রহণযোগ্য মুদ্রা ব্যবহারের বিকল্প পথ গ্রহণ করতে হবে। ব্যাংকের সুদ হার পুননির্ধারণ করতে হবে।
৬.নিরুপায় ও অসহায়, আয়হীন, কর্মহীন মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষা খাত ব্যবস্থাপনাকে স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত ও প্রসারিত করতে হবে। নিম্ম আয়, স্বল্প আয়, সীমিত আয়ের মানুষদের ক্রয় ক্ষমতা ধরে রাখতে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। টিসিবির মাধ্যমে ‘খোলা বিক্রয়’ ব্যবস্থাকে আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। কল-কারখানা-শ্রমিকদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ বিশ্বাস করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ধৈর্য্য ও প্রজ্ঞার সাথে বৈশ্বিক মহামারি করোনা মোকাবেলা করেছেন, জাতীয় অর্থনীতিকে স্বাবলম্বি ধারায় পরিচালিত করেছেন- সেই প্রজ্ঞা ও সাহস নিয়ে আন্তর্জাতিক সংকটে জাতীয় অর্থনীতিতে যে সাময়িক বাড়তে চাপ তৈরি হয়েছে তা মোকাবেলা করে জনগণকে স্বস্তি প্রদানে তাঁর সক্ষমতা প্রদর্শণে সফল হবেন।