বাংলাদেশের ক্রিকেটে কোনও কোনও ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সাফল্যই বেশি। এই যেমন ছেলেরা এখন পর্যন্ত এসিসি কিংবা আইসিসির কোনও ট্রফি জিততে পারেনি, কিন্তু মেয়েরা এশিয়া কাপের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। এই সাফল্যের আনন্দের মধ্যে কিছু বিষাদও আছে। আছে না পাওয়ার ক্ষোভ কিংবা পদে পদে বঞ্চনার গল্পও। তবু নারী ক্রিকেটাররা এগিয়ে যাচ্ছেন, নিজেদের কাজটা ঠিকঠাক করছেন।
একটা সময় নানা অনুরোধে বড় দলগুলো খেলতে এলেও কোয়ালিফায়ার কিংবা আইসিসি ইভেন্টের ম্যাচগুলোই ছিল নারী ক্রিকেটারদের ভরসা। এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। পারফরম্যান্স দিয়ে নারীরা আইসিসি ওয়ানডে সুপার লিগে খেলছেন, খেলছেন ভারত-অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের বিপক্ষে।
বাংলাদেশের ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোর মধ্যে বিসিবিই এশিয়ার অন্যতম ধনী ক্রিকেট বোর্ড। ক্রিকেট ছাড়াও তারা অন্য অনেক ক্রীড়া ফেডারেশন, ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সহায়তা করে থাকে। কিন্তু নারী ক্রিকেটারদের সুযোগসুবিধা দেওয়ার বেলায় বিসিবির থাকে নানা অজুহাত! মেয়েদের ক্রিকেট নিয়ে স্পন্সরদের আগ্রহ কমই থাকে। শুধু বাংলাদেশে নয়, পুরো ক্রিকেট বিশ্বেই এটা বাস্তবতা। তাই অনেক দেশেই মেয়েদের ক্রিকেটে ভর্তুকি দিয়ে থাকে সংশ্লিষ্ট বোর্ড। কিন্তু বিসিবি ২০ কোটি টাকার বাজেটের বাইরে কোনও কিছুই করতে চায় না। এই যেমন বাজেটসহ মাঠ না পাওয়ার অজুহাতে এবার মেয়েদের জাতীয় লিগই মাঠে গড়ালো না।
শুধু মাঠের খেলার বেলাতেই নয়, আর্থিক বিষয়ে বৈষম্যের শিকার নারী ক্রিকেটাররা। গত বছর মেয়েদের বেতন বাড়লেও অন্য সুযোগ-সুবিধা খুব একটা বাড়েনি। কেন্দ্রীয় চুক্তিতে থাকা নারী ক্রিকেটারদের সর্বোচ্চ বেতন ১ লাখ টাকা। তাও এই ক্যাটাগরিতে ক্রিকেটারদের সংখ্যা মাত্র তিনজন। সর্বনিম্ন বেতন ৩০ হাজার টাকা। অন্য দিকে পুরুষ ক্রিকেটারদের সর্বোচ্চ বেতন ৯ লাখ টাকা। সর্বনিম্ন ১ লাখ টাকা বেতন। বেতনের এই কাঠামোতেই বোঝা যাচ্ছে- কতটা বৈষম্যের শিকার নারীরা। শুধু বেতন নয় ম্যাচ ফিতেও বিস্তর পার্থক্য। নারীরা ওয়ানডে খেলে পায় ১ লাখ, পুরুষ ক্রিকেটাররা পায় ৩ লাখ টাকা। অন্যদিকে টি-টোয়েন্টি খেলে সাকিব-মুশফিকরা দুই লাখ টাকা পেলেও নিগার সুলতানারা পাচ্ছেন ৫০ হাজার টাকা।
নারী-পুরুষের এই ব্যবধান স্বীকার করে নিলেন বিসিবির পরিচালক ও উইমেন্স কমিটির চেয়ারম্যান শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল। তার দাবি, বিসিবির সদিচ্ছা থাকলেও বাস্তবতার কারণে কিছু করা যাচ্ছে না। বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেছেন, ‘অবশ্যই সুযোগ-সুবিধা আপ টু দ্য মার্ক নয়। নারীদের এগিয়ে নিতে আরও অনেক কিছু করার আছে। সেই সুযোগ আছে, করা উচিতও। কিন্তু আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। আমাদের নির্দিষ্ট বাজেটের মধ্যেই সবটুকু করতে হচ্ছে।’
এক সময় জাতীয় দলে খেলেছেন। এখন আম্পায়ারিং করছেন সাথিরা জাকির জেসি। সাবেক এই ক্রিকেটার মনে করেন- আগের চেয়ে বৈষম্য অনেকটা কমেছে। বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেছেন, ‘আমার তো মনে হয় আগের চেয়ে সুযোগ-সুবিধা অনেকখানি বেড়েছে। এখন সর্বোচ্চ বেতন এক লাখ টাকা হয়ে গেছে। বাংলাদেশের বিবেচনায় অন্য স্পোর্টসের তুলনায় নারী ক্রিকেটাররা ভালো একটা সম্মানী পাচ্ছেন। তবে এটা তারাই পাচ্ছে যারা ভালো পর্যায়ে আছে, কেন্দ্রীয় চুক্তিতে আছে। অন্য যারা আছে তারা হয়তো বেতন পাচ্ছেন না।’
নারী দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতি অবশ্য মনে করেন নারী ক্রিকেটের প্রচার না থাকার কারণে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না। তার মতে, মানুষের আগ্রহ না থাকায় বড় বড় স্পন্সরও পাওয়া যাবে না, অবশ্য আমাদের সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। বিসিবি আমাদের জন্য অনেক করছে। কিন্তু আমাদের তো ইচ্ছে করে আরও সুযোগ-সুবিধা পেতে। অনেককেই বলতে দেখি, আমাদের স্পন্সর নেই। আমার প্রশ্ন, স্পন্সর আসবে কেন? আপনি যদি প্রচার না করেন তাহলে মানুষ জানবে কী করে। আমাদের মেয়েদের খেলা হয়, কোনও টিভি লাইভ করে না। আমার গ্রামের দাদা সে তো স্মার্ট ফোন চালায় না, কিন্তু টিভিতে দেখালে সেও কিন্তু খেলাটা দেখতে পারতো। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, তাদের নারী ক্রিকেট এখন অনেক জনপ্রিয়। তারা কী শুরুতেই এত জনপ্রিয়তা পেয়ে গেছে। ওরা ঘরোয়া ক্রিকেটও দেখায়। দেখাতে দেখাতে এক সময় জনপ্রিয়তা তৈরি হয়েছে। আমাদের স্পোর্টস চ্যানেল নারী বিগ ব্যাশের খেলা দেখায় অথচ আমাদের ম্যাচ দেখায় না। প্রচার না হলে প্রসার কী করে হবে বলেন?’
জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার ও নারী উইমেন্স কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা হাবিবুল বাশার সুমন বিষয়টিকে দেখছেন অন্যভাবে। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেছেন, ‘সামগ্রিকভাবে বিচার করলে অবশ্যই নারীরা পিছিয়ে আছে। একটা ছেলে ক্রিকেট খেলতে এসে যে সুবিধাটা পায়, সেটা কিন্তু মেয়ে পায় না। যে কোনও বিভাগ, জেলাতে গিয়ে একটা ছেলে চাইলে অনুশীলন করতে পারে। কিন্তু একটা মেয়ে এই সুযোগটা পায় না। ওখানে ওদেরকে বেশ প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হয়।’
তবে সমস্যাটা শুধু জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের বৈষম্য নিয়েই নয়, সবচেয়ে বড় বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন ঘরোয়া ক্রিকেট খেলা নারী ক্রিকেটাররা। কেন্দ্রীয় চুক্তিতে থাকা ক্রিকেটারদের সম্মানী সন্তোষজনক হলেও চুক্তির বাইরে থাকা ক্রিকেটারদের রুটি-রুজির উৎস ঘরোয়া ক্রিকেট। কিন্তু সেটিই নিয়মিত হচ্ছে না নানা অজুহাতে। কখনও মাঠ সংকট, কখনও বা আন্তর্জাতিক ব্যস্ততা। সবমিলিয়ে কেন্দ্রীয় চুক্তির বাইরে থাকা ক্রিকেটারদের নাজেহাল অবস্থা। কেন্দ্রীয় চুক্তির বাইরে থাকা এক ক্রিকেটার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘বিসিবি চাইলে সব সম্ভব। আমাদের মাঠ সংকটের দোহাই দিয়ে খেলা নামানো হচ্ছে না। অথচ আমাদের রুটি-রুজির মূল উৎসই হচ্ছে ঘরোয়া ক্রিকেট। ছেলেদের বিপিএলের পর প্রিমিয়ার লিগ শুরু হচ্ছে ১১ তারিখ। আমাদের একটা মাত্র টুর্নামেন্ট যেখান থেকে আমরা একটু আয় করতে পারি। শুধুমাত্র জাতীয় দলকে নিয়ে চিন্তা করলে তো হবে না। আমাদের সঙ্গে এটা অবিচার হচ্ছে।’
এদিকে অনেক নারী ক্রিকেটারের সামনে সুযোগ ছিল ক্রিকেটকে কোচিং পেশা হিসেবে নেওয়ার। কিন্তু এখানেও খুব বেশি সুযোগ-সুবিধা নেই। রেশমা আক্তার, ডলি আক্তার ও ফাতেমা জহুরাই কেবল কোচিং পেশায় জড়িত। এর মধ্যে ফাতেমা মালদ্বীপে কোচিং পেশায় নিয়োজিত। সাবেক ক্রিকেটার সাথিরা জাকির জানিয়েছেন কোচিং পেশাতে বাংলাদেশের নারীদের খুব বেশি কিছু করার কিংবা পাওয়ার নেই। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেছেন, ‘মেয়েদের সুযোগ নেই এখানে আসলে। নারী ক্রিকেটাররা যে কোচিংয়ে আসবে, সেই সুযোগটাও থাকতে হবে। ধরেন আমি যদি কোচিংয়ে আসি, কোচিংয়ে এসে আমি কোথায় কোচিং করাবো। বছরে দুইটা লিগের জন্য তো আমি বসে থাকতে পারবো না। দুইটা লিগে আমাকে পারিশ্রমিকই বা কত দেবে। ছেলেদের কোচরাও সেভাবে পারিশ্রমিক পায় না। যার কারণে মেয়েদের এই সেক্টরে আগ্রহ একেবারেই কম।’