রাঙ্গামাটি জেলা প্রতিনিধি : সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করবে কী করবে না তার আশায় বসে থেকে লাভ নেই। আগামী দিনে কঠোর আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। আজ শুক্রবার (২০মে) পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ৩৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষ্যে রাঙ্গামাটিতে আয়োজিত ছাত্র সমাবেশে তিনি এই আহবান জানান।
রাঙ্গামাটি শহরের জিমনেশিয়াম মাঠে এই ছাত্র সমাবেশের আয়োজন করে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ। ছাত্র সমাবেশের শুরুতে জাতীয় সংগীত ও সংগঠনটির দলীয় সংগীত পরিবেশন করে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এর পরই বেলুন উড়িয়ে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদেও ৩৩তম সম্মেলনের উদ্ধোধন করেন পাহাড়ের বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মংসানু চৌধুরী। এরপর পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি সুমন মারমা’র সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক নিপন ত্রিপুরার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত হয় সমাবেশ।
সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। এছাড়াও বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরিণ, পাহাড়ের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শিশির চাকমা, সাংবাদিক নজরুল কবীর, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক টনিস ম্যাথিউ চিরান, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সহ-সভাপতি রায়হান উদ্দীন প্রমুখ।
সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক জগদীশ চাকমা। তাঁর বক্তব্যে তিনি বলেন, ঐতিহাসিকভাবে পাহাড়ের জুম্ম জনগণের উপর যে ধরণের দমণ-পীড়ন চালানো হয়েছে তার প্রতিবাদেই মূলত পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের জন্ম। শাসক গোষ্ঠীর দমন-পীড়ন এবং নির্যাতন এখনো অব্যাহত রয়েছে। সেই অব্যাহত নিপীড়নের বিরুদ্ধে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ আজকের সমাবেশের মধ্য দিয়ে আগামী দিনের আন্দোলন জোরদার করার শপথ নিতে চাই। জুম্ম জনগণের মুক্তির সনদ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে যাবে বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এই ছাত্র নেতা।
পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত যারা পিসিপি’র সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন এবং ত্যাগ স্বীকার করে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় যুক্ত থেকেছেন তাঁদের সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও সমাবেশের প্রধান অতিথি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা বলেন, কাপ্তাই বাঁধের সময়ও পাহাড়ের জুম্ম ছাত্র সমাজ এম.এন লারমার নেতৃত্বে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। কিন্তু সেসময়ের ঘুনে ধরা সামন্ত নেতৃত্বের কারণে সেই প্রতিবাদ সফল হতে পারেনি। তারই পরে পাহাড়ী ছাত্র সমিতির নেতৃত্বে নতুন করে একটি রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে উঠেছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৯ সালের লংগদু গণহত্যার ঘটনার প্রতিবাদে পাহাড়ের যে ছাত্র-যুব সমাজকে সংঘবদ্ধ করেছিল তারই ফলে যে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের জন্ম হয় তার ৩৩ বছরের আন্দোলনের ইতিহাসকে আজকে স্মরণ করতেই হবে।
তিনি আরো বলেন, পাকিস্তান শাসনামলে যে বাস্তবতা, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও একই বাস্তবতা। পাকিন্তান সরকার ব্রিটিশ প্রণীত ১৯০০ সালের শাসনবিধিকে খর্ব করে, কাপ্তাই বাঁধের মধ্য দিয়ে জুম্ম জনগণকে নিশ্চিহ্ন করার কাজকে সম্প্রসারণ করেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ শাসনামলে ১৯৭২ সালের সংবিধানে পার্বত্য অঞ্চলের জুম্ম জনগণের স্বতন্ত্র সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে বলা হয় সাংবিধানিকভাবে তারা বাঙালি। বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথমে অপারেশন দাবানল এবং ২০০১ সালে অপারেশন উত্তোরণ ঘোষণা দেয় বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
সন্তু লারমা আরো বলেন, আজকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ টি বছর অতিবাহিত হতে চলেছে। ২৫ বছরেও বাংলাদেশ সরকার এটা অনুভব করে নাই যে, পাহাড়ে ‘অপারেশন উত্তোরণ’ ঘোষণার মাধ্যমে পাহাড়কে যে উপদ্রুত এলাকা করা হয়েছে সেই বিশেষণ প্রত্যাহার করা দরকার। বরং আমরা দেখেছি পাহাড়ে ধীরে ধীরে শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন-বঞ্চনা ও দমন-পীড়ন সেটা সম্প্রসারিত হয়েছে। আমরা এমন একটা অবস্থায় থাকতে বাধ্য হচ্ছি যে, যেখানে হাত-পা থাকলেও, দৃষ্টিশক্তি থাকলেও, বুদ্ধি বিবেচনা থাকলেও, জন্মভূমির প্রতি এবং বসতবাড়ীর প্রতি আমাদের মায়া-মমতা থাকলেও আমরা আজকে সেটা কোনোভাবেই প্রকাশ করতে পারছি না। তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চুক্তির বয়স আজ ২৫ বছর। তারও আগে থেকে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের লড়াইয়ের সূচনা। তারও আগে ভারত বিভক্তি সময় এবং কাপ্তাই বাঁধের সময়ও পাহাড়ী ছাত্ররা আন্দোলন করেছিল। এখনো পর্যন্ত পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দ নিজেদের জন্মভূমি রক্ষা, নিজেদের বসত-ভিটা রক্ষার আন্দোলন করে যাচ্ছে। ৩৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দ আরো গভীরভাবে ভাববে এবং এই লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন জনসংহতি সমিতির সভাপতি।
তিনি আরো বলেন, সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করবে কী করবে না তার আশায় বসে থেকে লাভ নেই। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দের যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব তা কাঁধে নিয়ে আগামী দিনের ছাত্র আন্দোলন কঠোর থেকে কঠোর করার আহ্বান জানিয়েছেন।