লোকমান আনছারী চট্টগ্রাম:
একবিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগের মানুষ আমরা। তথ্যপ্রযুক্তির অবারিত গতি পৃথিবীবাসী মানুষকে করেছে দেশ-জাতি-ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে বিশ্বসভার সদস্য। সামগ্রিক অর্থে বর্তমান সময়ে পৃথিবীর সব মানুষ এক ছাদের বাসিন্দা। বিষয়টি অনেক আগেই পারস্য প্রতিভা, সাধক কবি আল্লামা শেখ সাদী উল্লেখ করেছেন ‘বনি আদম আযা-ই-য়ক দিগর বন্দু। কে দর আফ্রিনশ বে য়ক জওহরন্দ।’ অর্থাৎ, আদম সন্তানরা একটি দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো। কেননা, তাদের সৃষ্টির মূল উৎস একটাই। একটি অঙ্গে যখন যন্ত্রণা হয় অন্য অঙ্গগুলোর তখন স্বস্তি থাকে না। অন্যদের ব্যথায় যদি নির্বিকার থাকো তাহলে তুমি মানুষ নামে আখ্যায়িত হবার যোগ্য নও।
মানুষে মানুষে প্রীতিময় সম্পর্ক সদ্ভাবের অকৃত্রিম বাসনার প্রতিফলন। ছিল মানব সৃষ্টির সূচনালগ্নে একমাত্র স্রষ্টা মহান আল্লাহর। কিন্তু খোদার পৃথিবীতে আমরা বিভক্ত, পারস্পরিক হানাহানি, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, হিংসা-বিদ্বেষ-বিদ্রুপতায় অতিষ্ঠ পৃথিবীকে আমরাই করেছি কলঙ্কিত। একবিংশ শতাব্দীতেও আমাদের বিভাজন ধর্মে-অধর্মে, নৈতিকতা-অনৈতিকতায়, সততা-শঠতায়, হীনম্মন্যতা এবং সাম্প্রদায়িকতায়। এখানে মানুষের নেতিবাচক দিকগুলোর ভিত্তি হচ্ছে অহংকার, আত্মগৌরব, ক্ষমতা ও সম্পদের লোভ, অনুদারতা এবং দাম্ভিকতা। এসব অসুন্দরের প্রতীক। এ ধরনের আচরণ কখনও ঠিক নয়, মানবসমাজে অহংকার, দাম্ভিকতা, লোভ, অহমিকা কখনও ঐশী বার্তা নয়। বরং দানবীয় দোষপুষ্ট, ভ্রষ্টাচার। এই ধরনের নানামুখী নেতিবাচক আচরণ থেকে মানবসমাজকে মুক্ত রাখার অঙ্গীকার নিয়ে পৃথিবীর মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আহ্বান হচ্ছে মাইজভাণ্ডারীয়া তরিকা। এই তরিকায় অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে রয়েছে বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি।
ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশাল ধর্মীয় পরিমণ্ডলের সন্তান এবং প্রতিনিধি। ধর্মীয় পরিসর এবং পরিবেশ আমাকে গোঁড়ামি ও কুসংস্কারমুক্ত হতে পূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করেছে। আমার ধর্মবিশ্বাস আমাকে দেশ-কাল-জাতি- ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে এক মহান আশ্রয়স্থলের বাসিন্দা করেছে। আমার ধর্ম আমাদের শিখিয়েছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ কাল অতিক্রম করে মহাকালের অভিযাত্রী ‘মানুষ’ হতে। আমার ধর্মীয় কিতাব এবং পরিবেশ আমার ব্যক্তিগত চিন্তাচেতনা প্রসারিত করে বিশ্বাসী হতে শিখিয়েছে, সব মানুষ এক আল্লাহর সৃষ্ট বান্দা, এক আদমের সন্তান। আমরা এক আল্লাহতে বিশ্বাসী , সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ ‘মানবজাতি’। আমার ধারণায় দৃঢ়তা এই যে, তাওহিদ তথা একত্ববাদকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে মানবসম্প্রদায় সহজেই একটি ছাদের নিচে সুখ ও শান্তির নিবাস গড়ে তুলতে পারে। এজন্য নিশ্চিত করা প্রয়োজন মানব সাম্য, ধর্ম এবং মতাদর্শ সমূহের শান্তিপূর্ণ কর্মধারা ও সহাবস্থান, পার্থিব সম্পদের সুষম বণ্টন ব্যবস্থা, সর্বোপরি মানবাধিকার সংরক্ষণ এবং মানবজাতির পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও নৈকট্যের স্বার্থে বিচার সাম্য। তাই খোদার পৃথিবীতে জালিম-মজুলুমের অবস্থান আমাদের কাম্য নয়। মাইজভাণ্ডারী পরিমণ্ডল থেকে উপর্যুক্ত আদর্শের আলোকে বিশ্ববাসীকে ঐক্য ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এই দাওয়াত পেশ করা হয়ে থাকে।
মাইজভাণ্ডারীয়া তরিকা অনুশীলন পদ্ধতিতে আমরা হক্কুল্লাহ এবং হক্কুল ইবাদ মিশনকে সমভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকি। সৃষ্টির কল্যাণ ও মানবসেবা ব্যতীত স্রষ্টা সান্নিধ্য সম্ভব নয়। এ বিষয়কে বেগবান করার নিমিত্তে শাহেনশাহ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী ট্রাস্টের পক্ষ থেকে বেশ কিছু সেবাধর্মী, জনকল্যাণমুখী, শিক্ষা স্বাস্থ্য এবং তথ্য ও গবেষণাকেন্দ্রিক কর্মসূচির মাধ্যমে অগ্রসর মানুষ তৈরির পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়ে থাকে। আমাদের সীমাবদ্ধ আঙিনায় শিক্ষা প্রকল্পের আওতায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য বৃত্তি তহবিল প্রকল্প, ধর্মীয় শিক্ষা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং সমসাময়িক সমস্যা সম্পর্কে সংলাপের ব্যবস্থা চালু রয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে যাকাত তহবিল থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগী কল্যাণ সমিতিকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান, ব্যবসায় পুঁজি ও আর্থিক সহায়তা দান, ঋণ পরিশোধে সহায়তা, মৎস্য-হাঁস মুরগির খামারে সহায়তা, কৃষিকাজে কলের লাঙল ক্রয়ে সহায়তা, মহিলাদের প্রশিক্ষণ ও সেলাই মেশিন প্রদান, মাছ ধরার জাল ও নৌকা ক্রয়ে সহায়তা, মোটরকার ও সিএনজি সহায়তা, শিক্ষা, বিবাহ, গৃহনির্মাণ ও চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া দক্ষ নারী উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় রয়েছে ৫৯টি সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
যাকাত তহবিলের বাইরে চলমান রয়েছে অমুসলিম দুস্থ সহায়তা তহবিল, সাধারণ দুস্থ সহায়তা তহবিল এবং দুস্থ আলেম সহায়তা তহবিল। স্বাস্থ্যসেবা খাতে দুস্থ দরিদ্র ব্যক্তিবর্গের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসার সুযোগ হিসেবে চলমান রয়েছে ১০টি দাতব্য চিকিৎসালয়। এসব চিকিৎসালয়ে দুস্থ দরিদ্র লোকজন চক্ষু চিকিৎসা, খৎনা, নাক-কান ফোঁড়ানো, প্রসূতিদের চিকিৎসাসহ বিভিন্ন রোগীর প্রাথমিক ও জরুরি সেবা পেয়ে থাকেন।
শাহেনশাহ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী ট্রাস্টের আওতায় আত্মশুদ্ধি অর্জন ও আত্মোন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য রয়েছে যুব সংগঠন ‘তাজকিয়া’। ট্রাষ্টের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ‘মাইজভাণ্ডারী একাডেমি’ এবং গবেষণা ও প্রকাশনা সেল। মাইজভাণ্ডারী একাডেমির তত্ত্বাবধানে ‘আলোকধারা বুকস’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় তাসাওউফ বিষয়ে বহুমুখী গবেষণা ও বিশেস্নষণমূলক জার্নাল মাসিক আলোকধারা। এছাড়া প্রকাশনা সেল থেকে ইতোমধ্যে ৪৫ টি গ্রন্থ, পুস্তক, পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে। ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে মাইজভাণ্ডারী একাডেমির পরিচালনায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছয়টি সুফি সম্মেলন এবং বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। মাইজভাণ্ডারী একাডেমির উদ্যোগে প্রতি বছর গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর ১০ মাঘ ওরস উপলক্ষে ট্রাষ্টের ব্যবস্থাপনায় ১০ দিনব্যাপী কর্মসূচির আওতায়
‘শিশু-কিশোর সমাবেশ (মাঘ উৎসব), উলামা সমাবেশ. আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি সম্মিলন, শিক্ষক সমাবেশ প্রভৃতির আয়োজন করা হয়ে থাকে