আনোয়ার সাদত জাহাঙ্গীর,ময়মনসিংহঃ
বহুল আলোচিত এবং মর্মান্তিক ভাবে ময়মনসিংহের ত্রিশালে ট্রাকচাপায় মায়ের পেট ফেটে সড়কে জন্ম নেওয়া ও অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া নবজাতক ফাতেমাকে রাজধানী ঢাকার আজিমপুর ছোট মনি শিশু নিবাসে পাঠানো হয়েছে। শুক্রবার (২৯ জুলাই) বেলা ১১টার দিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে গাড়িযোগে শিশুটিকে ঢাকা আজিমপুর শিশু নিবাসে পাঠানো হয় এবং দুপুর ২.৩০ মিনিটে তাকে হস্তান্তর করা হয়। এর আগে সকাল ১০টার দিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ওয়ায়েজ উদ্দিন ফরাজি ওই শিশুকে জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ ওয়ালীউল্লাহ ও নবজাতকের দাদা মোস্তাফিজুর রহমান বাবলুর কাছে হস্তান্তর করেন।পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী শিশুটির নাম রাখা হয় ফাতেমা আক্তার এবং ঢাকায় পাঠানো হয়।
ত্রিশাল সমাজসেবা কার্যালয়ের সমাজসেবা কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান জানান,আমরা দুপুর ২.৩০ মিনিটে আজিমপুর ছোটমনি নিবাসের উপ-তত্তাবধায়ক জুবলী বেগম বানুর কাছে শিশুটিকে হস্তান্তর করেছি।জেলা শিশু কল্যাণ বোর্ডের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাকে সাময়িক সময়ের জন্য এখানে রাখা হয়েছে।বেলা ১১টার দিকে আমি ও ময়মনসিংহ জেলা সরকারি শিশু পরিবার (বালিকা) এর খালাম্মা তাহমিনা আক্তার স্বপ্না,শিশুটির দাদা মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু,শিশুটির বোন জান্নাতুল ফেরদৌসী জান্নাত এবং একজন পুলিশ অফিসারসহ তিনজন পুলিশ সদস্য নবজাতককে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে সেখানে উপস্থিত হই এবং হস্তান্তর করি। সকালে মমেক হাসপাতাল চত্বর থেকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ওয়ায়েজ উদ্দিন ফরাজি, হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক (শিশু ও নবজাতক) ডা.মো. নজরুল ইসলাম,জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ওয়ালীউল্লাহ নবজাতককে গাড়ীতে উঠিয়ে দিয়ে বিদায় জানান।
ময়মনসিংহ জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ ওয়ালীউল্লাহ জানান, ‘সুবিধাবঞ্চিত শিশু হিসেবে শিশু কল্যাণ বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নবজাতককে ঢাকা আজিমপুর ছোট মনি শিশু নিবাসে পাঠানো হয়েছে। সম্পূর্ণ সরকারি তত্তাবধানে নবজাতককে দেখাশোনা করা হবে।আমরা যথাসম্ভব সব সময় শিশুটির খোঁজ রাখবো।
নবজাতক শিশুটির দাদা মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু জানান,এতিম এই শিশুটির নাম ফাতেমা আক্তার রাখার জন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মোঃ এনামুল হক এবং কমিটির সদস্যরা সবাই মিলে‘ফাতেমা আক্তার’নাম রাখায় আমরা খুশি।আমার সম্মতিতে প্রশাসন নাতি ফাতেমাকে আজিমপুর ছোট মনি নিবাসে পাঠিয়েছে।নাতিকে দেখার ইচ্ছা হলে আমি যে কোনো সময় তাকে দেখতে যেতে পারবো বলে তারা জানিয়েছেন।আমি নিজে সেখানে আমার আরেক নাতি জান্নাতসহ গিয়েছিলাম। তিনি আরও জানান,জেলা প্রশাসন থেকে আমাকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে আমাদের থাকার জন্য দুই রুমবিশিষ্ট একটি হাফ বিল্ডিং এবং অপর দুই শিশু জান্নাত ও এবাদুল্লাহর লেখাপড়াসহ সার্বিক সহায়তা করা হবে। এতে আমরা খুব খুশি হয়েছি। নাতিকে ঢাকায় রেখে আসার পর কান্নায় ভেঙে পড়েন দাদা মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক (শিশু ও নবজাতক) ডা মোঃ নজরুল ইসলাম জানান,ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৫জন চিকিৎসক নিয়ে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে আমরা ১২ দিন ওই নবজাতককে চিকিৎসা দিয়েছি। শিশুটির জন্ডিস ও শ্বাসকষ্ট পুরোপুরি ভালো হলেও ঘাড়ে এবং ডান হাতে ফ্ল্যাকচার ভালো হতে দুই সপ্তাহের মতো সময় লাগতে পারে।
ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো.আক্তারুজ্জামান জানান,আমরা শিশুটির পরিবারকে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়েছি।আমি নিজে বাড়ী গিয়ে অনাথ দুই শিশুর জন্য খাবারসহ পোষাক কিনে দিয়েছি।নবজাতকের জন্য ত্রিশাল সোনালী ব্যাংকে একটি একাউন্ট করে দেওয়া হয়েছে।যেটি পরিচালনা করবেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার,ত্রিশাল ও মেয়ের দাদা মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু ।গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এই একাউন্টে জমা হয়েছে সাড়ে চার লাখ টাকা।
গত ১৬ জুলাই দুপুরের পরে উপজেলার মঠবাড়ী ইউনিয়নের রায়মনি গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম (৪০) তার অন্তঃসত্তা স্ত্রী রত্না আক্তারকে (৩০) নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চেকআপের জন্য আসেন এবং একটি বেসরকারী ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আল্ট্রাসনোগ্রাফ করাতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক পার হওয়ার সময় ট্রাক চাপায় স্বামী-স্ত্রী ও মেয়ে সানজিদা আক্তার (৬) প্রাণ হারান।এ সময় অন্তঃসত্তা রত্না আক্তারের পেট ফেটে বেরিয়ে আসে এই নবজাতক।পরে ওই নবজাতক নগরীর বে-সরকারী লাবিব হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল।
লাবিব হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ শাহজাহান ও তার স্টাফরা খুব যত্ন সহকারে তার সেবা দেন।জেলা প্রশাসক এনামুল হক উপস্থিত হয়ে শিশুটির খোজ নেন এবং সেখানে অবস্থার অবনতি হলে ১৮ জুলাই রাতে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এনআইসিইউতে ভর্তি করা হয়। সেখার তার জন্ডিস,ঘাড়ে এবং ডান হাতে ফ্ল্যাকচার ধরা পড়ে। মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট মেডিকেল বোর্ড গঠন করে শিশুটিকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং সুস্থ হলে ছোটমনি নিবাসে পাঠানো হয়। উল্লেখ,নবজাতক ফাতেমার দাদা ও দাদী দুজনই প্রতিবন্ধী এবং তাদের দুই ছেলেই সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করেছেন। এই পরিবারে এখন আর উপাজর্নক্ষম কেউ নেই।নিহত জাহাঙ্গীর আকিজ পার্টিকেল বোর্ডে শ্রমিকদের সর্দার হিসেবে কাজ করতেন।