পবিত্র রমজানে নাজাতের দশদিন গণনা শুরু হয়েছে গত পাঁচ দিন আগ থেকে। আর সে সাথে লাইলাতুল কদরও মুমিনে দ্বারে এসে কড়া নাড়ছে। লাইলাতুল কদর এর অর্থ অতিশয় সম্মানিত ও মহিমান্বিত রাত বা পবিত্র রজনী। আরবি ভাষায় ‘লাইলাতুল’ অর্থ হলো রাত্রি বা রজনী এবং ‘কদর’ শব্দের অর্থ সম্মান, মর্যাদা, মহাসম্মান। এ ছাড়া এর অন্য অর্থ হচ্ছে; ভাগ্য, পরিমাণ ও তাকদির নির্ধারণ করা। ইসলাম ধর্ম অনুসারে, এ রাতে মহানবী (সা.) এর সম্মান বৃদ্ধি করা হয় এবং মানবজাতির ভাগ্য পুনর্নির্ধারণ করা হয়।
তাই প্রতিটি মুসলমানের কাছে এই রাত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, মহাসম্মানিত ও মহিমান্বিত হিসেবে পরিগণিত। পবিত্র কোরাআন শরীফের বর্ণনা অনুসারে, আল্লাহ এই রাত্রিকে অনন্য মর্যাদা দিয়েছেন এবং এই একটি মাত্র রজনীর উপাসনা হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও অধিক সওয়াব অর্জিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবছর মাহে রমজানে এই মহিমান্বিত রজনী লাইলাতুল কদর বিশ্ব মুসলিমদের জন্য সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধি বয়ে আনে।
লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব মহান আল্লাহ এ রাতকে সকল রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।
পবিত্র কোরআনে এ রাতকে প্রশংসার সাথে উল্লেখ করেছেন আল্লাহ নিজেই। তিনি তাঁর কালাম সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইরশাদ করেন, নিশ্চয় আমি এটি নাজিল করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়, আমার নির্দেশে। নিশ্চয় আমি রাসুল প্রেরণকারী।
তোমার রবের কাছ থেকে রহমত হিসেবে; নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। যিনি আসমানসমূহ, জমীন ও এ দুয়ের মধ্যবর্তী সব কিছুর রব; যদি তোমরা দৃঢ় বিশ্বাস পোষণকারী হও। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনিই জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু দেন। তিনি তোমাদের রব এবং তোমাদের পিতৃ পুরুষদের রব। (দুখান ৩-৮)
বরকতময় রজনী হলো লাইলাতুল কদর। আল্লাহ বরকতময় বলে কুরান ও হাদিসে বিভিন্ন ভাবে অভিহিত করেছেন। কারণ এ রাতে রয়েছে যেমন বরকত তেমনি কল্যাণ ও তাৎপর্য। বরকতের প্রধান কারণ হল এ রাতে আল-কোরান অবতীর্ণ হয়েছে। এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আল্লাহর সিদ্ধান্ত লওহে মাহফুজ থেকে ফেরেশতাদের হাতে অর্পণ করা হয় বাস্তবায়নের জন্য। এ রাতের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হলো আল্লাহ তাআলা এ রাত সম্পর্কে একটি পূর্ণ সূরা অবতীর্ণ করেছেন। যা কিয়ামত পর্যন্ত পঠিত হতে থাকবে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয় আমি এটি নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে। তোমাকে কিসে জানাবে লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতারা ও রূহ (জিবরাইল) তাদের রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করে। শান্তিময় সে রাত ফজরের সূচনা পর্যন্ত। (সূরা কদর: ১-৫)
আল-কোরআনে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি লাইলাতুল কদর কোন রাত। তবে কোরআনের ভাষ্য হলো লাইলাতুল কদর রামাদান মাসে। কিয়ামত পর্যন্ত রামাদান মাসে লাইলাতুল কদর অব্যাহত থাকবে। এবং এ রজনী রামাদানের শেষ দশ দিনের মধ্যে হবে বলে সহিহ হাদিসে এসেছে। এবং তা রামাদানের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে হাদিসে এসেছে।
হাদিসে আছে, ‘রমাযানের শেষ দশ দিনে তোমরা কদরের রাত তালাশ করো। ’ (বোখারি ২০২০ মুসলিম :১১৬৯)
এবং রামাদানের শেষ সাত দিনে লাইলাতুল কদর থাকার সম্ভাবনা অধিকতর। যেমন হাদিসে আছে, তোমরা রামাদানের শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে কদরের রাত খোঁজ করো। (বোখারি: ২০১৭)
অধিকতর সম্ভাবনার দিক দিয়ে প্রথম হলো রামাদান মাসের সাতাশ তারিখ। দ্বিতীয় হল পঁচিশ তারিখ। তৃতীয় হল ঊনত্রিশ তারিখ। চতুর্থ হল একুশ তারিখ। পঞ্চম হল তেইশ তারিখ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ রাতকে গোপন রেখেছেন আমাদের উপর রহম করে। তিনি দেখতে চান এর বরকত ও ফজিলত লাভের জন্য কে কত প্রচেষ্টা চালাতে পারে। লাইলাতুল কদরে আমাদের কর্তব্য হলো বেশি বেশি নিজের জন্য আত্মীয় স্বজনদের জন্য দোয়া করলে আল্লাহ তা কবুল করেন।
লাইলাতুল কদর উপলক্ষে আমাদের করণীয়
ক. কদরের ফজিলত পাওয়ার উদ্দেশ্যে কিছু নফল ইবাদত করা, নফল নামাজ আদায় করা। কোরআন তেলাওয়াত করা, তাছবীহ তাহলীল পাঠ করা কর্তব্য। দুই দুই রাকআত করে নফলের নিয়ত করে যেকোনো সূরাই সূরা ফাতেহার সঙ্গে মিলিয়ে নামাজ পড়া যাবে। তাতে কোনো অসুবিধা নেই। উত্তম হলো নফল নামাজ ধীরে সুস্থে লম্বা লম্বা ক্বেরাত দিয়ে পড়া এবং ধীরস্থিরে রুকু-সিজদা আদায় করা।
খ. লাইলাতুল কদর হলো বছরের শ্রেষ্ঠ রাত। এ রাতের শ্রেষ্ঠ দোয়া হলো ক্ষমা চাওয়ার দোয়া। এ রাতে মহানবী (সা.) ক্ষমা চাওয়ার দোয়া শিক্ষা দিলেন যে, তুমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাও, ক্ষমা পাওয়ার জন্য দোয়া করো। হাদীস শরীফে আছে হযরত আয়েশা (রা.) মহানবী (সা.) কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ইয়া রাসূল আল্লাহ! যদি আমি বুঝতে পারি শবে কদর কোন রাত, তাহলে ঐ রাতে আমি কি বলব? আল্লাহর কাছে কি চাইব? প্রিয় নবী (সা.) তদুত্তরে বলেন তুমি বলবে, ‘হে আল্লাহ আপনি বড়ই ক্ষমাশীল। ক্ষমা করতে আপনি ভালবাসেন, তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন। ’ আরবি দোয়া হলো- আল্লাহুম্মা ইন্নাকা, আফুউন তুহেববুল আফওয়া, ফাওফু আন্নি (ইবনে মাজাহ)।
কেউ যদি জীবনে অনেক কিছু পায় কিন্তু ক্ষমা না পায়, তাহলে তার জীবন ব্যর্থ। তাই এ রাতে অন্তরকে নরম করে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়ার পূর্বে খাঁটি দিলে তওবা ইস্তেগফার করতে হয়।
খাঁটি তওবার চারটি শর্ত:
১. পূর্বের গুনাহ থেকে ফিরে আসা বা গুনাহ ছেড়ে দিতে হবে;
২. গুনাহর জন্য মনে মনে অনুতপ্ত হতে হবে যে, আমি বড়ই অন্যায় করেছি;
৩. ভবিষ্যতে ওই গুনাহ আর করবো না বলে মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে হবে;
৪. বান্দাহর কোনো হক নষ্ট করে থাকলে যথাসাধ্য সে হক আদায় করে দিতে হবে।
গ. এ রাতের আরেকটি আমল ফুকাহায়ে কিরামগণ বলেছেন যে, এ রাতে ইবাদাতের পূর্বে যদি কেউ গোসল করে নিতে পারে তার সেটাই উত্তম। উক্ত আমলগুলো শুধু ২৭ রামাদান নয় বরং রমজানের শেষ দশ দিনের প্রত্যেক বেজোড় রাতে শবেকদর তালাশ করতে হবে। এজন্য মহানবী (সা.) রামাদানের শেষ দশ দিনে ইতেকাফ করতেন। আর উম্মতের জন্য শরীয়তে ইতেকাফের বিধান কিয়ামত পর্যন্ত জারি রেখে গিয়েছেন যেন তারা ইতেকাফের মাধ্যমে লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব দিয়ে প্রত্যেকটি বেজোড় রাতে এবাদত করতে পারেন। আল্লাহ তায়ালা লাইলাতুল কদরে কোরআন নাজিল করেন। এ রাত বছরে একবার আসে আর চলে যায়। কিন্তু এ রাতের মহান নিয়ামত কোরআন মানব সমাজেই বিরাজমান থাকে চিরদিন। মানব জীবনে সাফল্য এই কোরআনের আমলের উপরই নির্ভরশীল। এই রাতের মর্যাদা মূল্যায়ন তখনই যথার্থ হবে। যখন আমরা কোরআনের নির্দেশিত পথে চলবো, আর কোরআনের বাহক মুহম্মদ (দ.) এর পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য করবো। এ রাতের সর্বাপেক্ষা মহৎ প্রাপ্তি হলো কোরআনের হক আদায় করা এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে কোরআন প্রদর্শিত পথে পরিচালিত করার জন্য নিজেদেরকে সর্বদা প্রস্তুত করা।
রামাদানের পুরো মাস জুড়ে বিরাজ করে রহমত, বরকত ও ক্ষমার ঘোষণা। তবে এ মাসে রয়েছে বিশেষ এক মহিমান্বিত রজনী লাইলাতুল কদর। আর লাইলাতুল কদর হাজার বছরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও পুণ্যময়।
আল্লাহ তাআলা এ রাতের ব্যাপারে বলেন, ‘কদর রজনী সহস্র মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সেই রজনীতে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতরণ করেন প্রত্যেক কাজে তাদের রবের অনুমতিক্রমে। শান্তিই শান্তি, সেই রজনী সুবহে সাদিক উদিত হওয়া পর্যন্ত।’ সুরা কদর, আয়াত : ৩-৫)
শবে কদর কী এবং শবে কদরের ইতিহাস, গুরুত্ব ও আমল
মুসলমানদের কাছে শবে কদর বা কদরের রাতের গুরুত্ব অপরিসীম। কুরআনের সুরা কদরে উল্লেখ আছে, হাজার মাস উপাসনায় যে পূন্য হয়, কদরের এক রাতের উপাসনা তার চেয়ে উত্তম।
‘শবে কদর’ বা ‘লাইলাতুল কদর’-এর অর্থ হলো ‘অতিশয় সম্মানিত ও মহিমান্বিত রাত’ বা ‘পবিত্র রজনী’। ফার্সি ভাষায় ‘শাব’ ও আরবি ভাষায় ‘লাইলাতুল’ অর্থ হলো রাত্রি বা রজনী, অন্যদিকে ‘কদর’ শব্দের অর্থ সম্মান, মর্যাদা, মহাসম্মান। এ ছাড়া এর অন্য অর্থ হল ভাগ্য, পরিমাণ ও তাকদির নির্ধারণ করা।
ইসলাম ধর্ম অনুসারে, শবে কদরে ইসলাম ধর্মের ধর্মপ্রচারক মহানবি হযরত মুহাম্মদ (দ:)-এর অনুসারীদের সম্মান বৃদ্ধি করা হয় এবং মানবজাতির ভাগ্য পুনর্নির্ধারণ করা হয়। এই কদরের রাতে হজরত মুহাম্মদ (দ:)-এর নিকট কুরআন অবতীর্ণ হয়েছিল। তাই মুসলমানদের কাছে এই রাত অত্যন্ত পুণ্যময় ও মহাসম্মানিত হিসেবে পরিগণিত। কুরআনের বর্ণনা অনুসারে, আল্লাহ এই রাত্রিকে অনন্য মর্যাদা দিয়েছেন এবং এই একটি মাত্র রজনীর ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও অধিক সওয়াব অর্জিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। পবিত্র রমজান মাসের কদরের রাতে কুরআন নাজিল হয়। প্রতিবছর মাহে রমজানে এই মহিমান্বিত রজনী লাইলাতুল কদর মুসলিমদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে বলে তারা বিশ্বাস করে। লাইলাতুল কদরের রাত ঠিক কোনটি তা বোঝা অনেকটাই অসম্ভব, তবে রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর একটিকে কদরের বলে মনে করায়।
শবে কদরের ইতিহাস
৬১০ সালে শবে কদরের রাতে মক্কার নূর পর্বতের হেরা গুহায় ধ্যানরত ইসলামের ধর্মের মহানবি, হযরত মুহাম্মদের (সা.) নিকট সর্বপ্রথম কুরআন নাজিল হয়। সর্বপ্রথম তার নিকট প্রথম সুরা আলাক্বের প্রথম পাঁচটি আয়াত নাজিল হয়। এ রাতে ফেরেশতা জীবরাইল এর নিকট সম্পূর্ণ কুরআন অবতীর্ণ হয় যা পরবর্তিতে ২৩ বছর ধরে ইসলামের নবি মুহাম্মদ (সা.) নিকট তার বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তা এবং ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট আয়াত আকারে নাজিল করা হয়।
মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রাত সর্ম্পকে হাদিস শরীফে অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে। এমনকি মুসলমানদের প্রধান ধর্মী গ্রন্থ আল কুরআনে সুরা ক্বদর নামে স্বতন্ত্র একটি পূর্ণ সুরা নাজিল হয়েছে। এই সুরায় শবে কদরের রাত্রিকে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইসলাম ধর্ম মতে, মুহাম্মদ (সা.)এর পূর্ববর্তী নবি এবং তাদের উম্মতগণ দীর্ঘায়ু লাভ করার কারণে বহু বছর আল্লাহর ইবাদাত করার সুযোগ পেতেন। কোরান ও হাদিসের বর্ণনায় জানা যায়, ইসলামের চার জন নবি যথা আইয়ুব, জাকরিয়া , হিযকীল ও ইউশা ইবনে নূন প্রত্যেকেই আশি বছর স্রষ্টার উপাসনা করেন এবং তারা তাদের জীবনে কোন প্রকার পাপ কাজ করেননি। কিন্তু মুহাম্মদ (সা.) থেকে শুরু করে তার পরবর্তী অনুসারীগণের আয়ু অনেক কম হওয়ায় তাদের পক্ষে স্রষ্টার আরাধনা করে পূর্ববর্তীতের সমকক্ষ হওয়া কিছুতেই সম্ভপর নয় বলে তাদের মাঝে আক্ষেপের সৃষ্টি হয়। তাদের এই আক্ষেপের প্রেক্ষিতে তাদের চিন্তা দুর করার জন্য সুরা কদর নাজিল করা হয় বলে হাদিসের বর্ণনায় জানা যায়।
শবে কদরের ধর্মীয় গুরুত্ব
মুসলমানদের কাছে শবে কদর এমন মহিমান্বিত বরকতময় এবং বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এ জন্য যে, এ রজনীতে মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থ ‘আল-কুরআন’ অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ কুরআনে ঘোষণা করেছেন, “নিশ্চয়ই আমি তা (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি কদরের রাতে। আর কদরের রাত সম্বন্ধে তুমি কি জানো? কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফেরেশতারা ও রুহ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিই শান্তি, বিরাজ করে উষার আবির্ভাব পর্যন্ত।” (সুরা আল-কদর, আয়াত ১-৫)।
কদরের রাত্রের যাবতীয় কাজের ইঙ্গিত দিয়ে এ রজনীর অপার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের অন্যত্র ঘোষণা করেছেন,
হা-মিম! শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের, নিশ্চয়ই আমি তা (কুরআন) এক মুবারকময় রজনীতে অবতীর্ণ করেছি, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। (সুরা আদ-দুখান, আয়াত: ১-৪)
ইসলাম ধর্ম মতে শবে কদরের রাতে ফেরেশতারা ও তাদের নেতা জিবরাঈল পৃথিবীতে অবতরণ করে উপাসনারত সব মানুষের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করতে থাকেন। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, শবে কদরে হজরত জিবরাঈল (আ.) ফেরেশতাদের বিরাট একদল নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং যত নারী-পুরুষ নামাজরত অথবা জিকিরে মশগুল থাকে তাঁদের জন্য রহমতের দোয়া করেন। (মাজহারি)
লাইলাতুল কদরে পরবর্তী এক বছরের অবধারিত বিধিলিপি ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফেরেশতাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিজিক, সবকিছুর পরিমাণ নির্দিষ্ট ফেরেশতাদেরকে লিখে দেওয়া হয়, এমনকি কে হজ্জ করবে, তা-ও লিখে দেওয়া হয়।
শবে কদরের গুরুত্ব
মুসলমানদের কাছে কদরের রাতের গুরুত্ব অপরিসীম। কুরআনের সুরা কদরে উল্লেখ আছে, হাজার মাস উপাসনায় যে পূন্য হয়, কদরের এক রাতের উপাসনা তার চেয়ে উত্তম। লাইলাতুল কদরের রাতে সৎ এবং ধার্মিক মুসলমানদের ওপর আল্লাহর অশেষ রহমত ও নিয়ামত বর্ষিত হয়। লাইলাতুল কদরে মুসলিমরা আল্লাহর কাছে মাগফিরাত, নাজাত ও ক্ষমা পাওয়ার পরম সুযোগ লাভ করে। লাইলাতুল কদর সম্পর্কে ইসলামের মহানবি বলেন, যে ব্যক্তি এ রাত ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করবে, আল্লাহ তাঁর পূর্বেকৃত সব গুনাহখাতা মাফ করে দেবেন। (বুখারি)
হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, লাইলাতুল কদরে যে বা যারা আল্লাহর আরাধনায় মুহ্যমান থাকবে, স্রষ্টা তার ওপর থেকে দোজখের আগুন হারাম করে দেবেন। এ সম্পর্কিত হাদিসটি হল, সমস্ত রজনী আল্লাহ তাআলা লাইলাতুল কদর দ্বারাই সৌন্দর্য ও মোহনীয় করে দিয়েছেন, অতএব তোমরা এ বরকতময় রজনীতে বেশি বেশি তাসবিহ-তাহলিল ও ইবাদত-বন্দেগিতে রত থাকো। অন্য হাদিসে তিনি বলেছেন, তোমরা তোমাদের কবরকে আলোকিত পেতে চাইলে মহিমান্বিত লাইলাতুল কদর রাতে জেগে রাতব্যাপী ইবাদত-বন্দেগিতে কাটিয়ে দাও।
কদরের রাত কোনটি?
হাদিস অনুযায়ী, ২০ রমজানের পর যেকোনো বিজোড় রাতে কদর হতে পারে। তবে ২৬ রমজান দিবাগত রাতেই লাইলাতুল কদর আসে বলে আলেমদের অভিমত। আয়েশা থেকে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে, মুহাম্মদ (সা.) রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন এবং বলতেন, তোমরা রমজানের শেষ ১০ রাতে শবে কদর সন্ধান করো। (বুখারি ও মুসলিম) আরেকটি হাদিসে মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, মাহে রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে তোমরা শবে কদর সন্ধান করো। (সহিহ বুখারি)
পুণ্যময় রাত্রি শবে কদর
ইসলামের মহানবিকে তার স্ত্রী আয়েশা শবে কদর সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, হে রাসুলুল্লাহ! আমি যদি লাইলাতুল কদর পাই তখন কী করব? তখন নবি মত দেন, তুমি বলবে, হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল, আপনি ক্ষমা করে দিতে ভালোবাসেন— অতএব, আমাকে ক্ষমা করুন। (তিরমিজি) মুসলমানদের ধারনায়, লাইলাতুল কদর গোটা মানবজাতির জন্য অত্যন্ত পুণ্যময় রজনী এবং এ রাত বিশ্ববাসীর জন্য স্রষ্টার অশেষ রহমত, বরকত ও ক্ষমা লাভের অপার সুযোগ এনে দেয়। এ রাতে কোরান শরীফ নাজিল হয় যার অনুপম শিক্ষাই ইসলামের অনুসারীদের সার্বিক কল্যাণ ও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি, ইহকালীন শান্তি ও পারলৌকিক মুক্তির পথ দেখায়।
শবে কদরের আমল
শবে কদরের আমল হলো:
১. নফল নামাজ
২. তাহিয়্যাতুল অজু
৩. দুখুলিল মাসজিদ
৪. আউওয়াবিন
৫. তাহাজ্জুদ
৬. সালাতুত তাসবিহ
৭. তাওবার নামাজ
৮. সালাতুল হাজাত
৯. সালাতুশ শোকর
১০. অন্যান্য নফল ইত্যাদি পড়া ও
১১.নামাজে কিরাত ও রুকু-সেজদা দীর্ঘ করা।
গ. কুরআন শরিফ
১. সুরা কদর
২. সুরা দুখান
৩. সুরা মুয্যাম্মিল
৪. সুরা মুদ্দাচ্ছির
৫. ইয়া-সিন
৬. সুরা ত-হা
৭. সুরা আর রহমান
৮. অন্যান্য ফজিলতের সুরাসমূহ তিলাওয়াত করা
৯. দরুদ শরিফ বেশি বেশি পড়া
১০. তাওবা-ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা
১১. দোয়া-কালাম, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আজকার ইত্যাদি করা
১২. কবর জিয়ারত করা
১৩. নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সব মোমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনায় দোয়া কামনা করা।
পরিশেষে মহান প্রভু যে উদ্দেশ্যে মুমিনের জন্য শবে কদর উপহার দিয়েছেন সেটিই যেন বাস্তবায়ন হয়। মুমিনের দ্বারে দ্বারে রহমত, বরকত ও মাগফিরাত লাভ করে নিজেকে ধন্য করতে পারে। হাজার মাসের চেয়ে উত্তম রাত্রি যেন প্রতিটি মুহুর্ত মহামুল্যবান। যেটি ৮৩বছরের সমপরিমান ইবাদতের সমান আজকের কদর রাত। সবার তাকদির চমকানো সবার ভাগ্যের দোয়ার যেন খুলে নিজেকে মহিমান্বিত করতে পারি এ কামনা রইল। আমিন।
হাফেয মাওলানা মুহাম্মদ রাহাত উল্লাহ
সহকারী শিক্ষক
উত্তর রাঙ্গুনিয়া উচ্চ বিদ্যালয়
rumamun1986@gmail.com