৩৩ বছর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জাকসু নির্বাচন আজ
দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এই ভোটকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে।
ভোটের প্রস্তুতি নিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ভোটের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে ২১টি কেন্দ্রে মোট ২২৪টি বুথ তৈরি করা হয়েছে। দায়িত্ব পালন করবেন ২১ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা, ৬৭ জন পোলিং কর্মকর্তা ও সমসংখ্যক সহকারী। ক্যাম্পাসে এক হাজারের বেশি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে এবং ভোটকেন্দ্রগুলোতে আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থাপন করা হয়েছে প্রায় ৮০টি সিসিটিভি ক্যামেরা। পাশাপাশি দুজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্বে থাকবেন।
এবার জাকসু নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ১১ হাজার ৭৪৩ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ৫ হাজার ৭২৮ এবং ছাত্র ৬ হাজার ১৫ জন। কেন্দ্রীয় সংসদের ২৫টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১৭৭ জন প্রার্থী। সহসভাপতি (ভিপি) পদে প্রার্থী ৯ জন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ৮ জন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে ৬ জন এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১০ জন। একই সঙ্গে ২১টি হল সংসদের ৩১৫টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৭৭ জন প্রার্থী।
জাকসু নির্বাচনে সাতটি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে—চারটি পূর্ণাঙ্গ এবং তিনটি আংশিক। পূর্ণাঙ্গ প্যানেলের মধ্যে রয়েছে ছাত্রদল–সমর্থিত প্যানেল, ছাত্রশিবির–সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট, প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের সম্প্রীতির ঐক্য এবং গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ–সমর্থিত ঐক্য ফোরাম। আংশিক প্যানেল দিয়েছে স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন, স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ এবং ছাত্র ইউনিয়ন–ছাত্র ফ্রন্টের সংশপ্তক পর্ষদ।
শিক্ষার্থীদের প্রধান দাবি হলো—গণরুম ও গেস্টরুম সংস্কৃতির অবসান, আবাসন সংকট সমাধান, নিরাপত্তা জোরদার, মানসম্মত খাবার সরবরাহ, পরিবহন সমস্যা নিরসন এবং দলীয় প্রভাবমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা। অনেক প্রার্থী নির্বাচনী প্রচারে এসব বিষয়কে অঙ্গীকার হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জাকসুর যাত্রা শুরু হয় ১৯৭২ সালে। স্বাধীনতার পরপরই প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৭২, ১৯৭৩, ১৯৭৪ সালে পরপর নির্বাচন হলেও পরে তা আর নিয়মিত হয়নি। ১৯৯২ সালের পর গত ৩৩ বছর ধরে আর কোনো নির্বাচন হয়নি। ওই সময় ছাত্রদল প্রায় একচেটিয়াভাবে জয়লাভ করে ১০৭টির মধ্যে ১০৫টি পদে বিজয়ী হয়েছিল। এরপর রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতা এবং শিক্ষকদের গ্রুপিংসহ নানা কারণে নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন কেবল শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জায়গা নয়, বরং জাতীয় আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে জাকসুর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। সাবেক ভিপি আশরাফউদ্দিন খানের ভাষায়, “আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের চেয়ে জাতীয় পর্যায়ে বেশি ভূমিকা রেখেছি।”
তবে অতীতের নানা বিতর্কিত ঘটনা শিক্ষার্থীদের মনে এখনো দাগ কেটে আছে। ১৯৭৩ সালের জিএস মোজাম্মেল হককে ক্যাম্পাসে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর আগে প্রথম জিএস শাহ বোরহানউদ্দিনও খুন হন নারায়ণগঞ্জে। দুই ক্ষেত্রেই ছাত্র রাজনীতির সহিংসতার প্রমাণ মেলে।
আজকের নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে ছাত্রদল–সমর্থিত প্যানেল, ছাত্রশিবির–সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট, গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ–সমর্থিত ঐক্য ফোরাম এবং স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলনের মধ্যে। স্বাধীন প্রার্থীরাও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রভাব ফেলতে পারেন।
প্রার্থিতা বাতিল, প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বা প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে কিছু অভিযোগ থাকলেও সার্বিকভাবে নির্বাচনকে ঘিরে প্রত্যাশা ইতিবাচক। শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, দীর্ঘ ৩৩ বছরের শূন্যতা কাটিয়ে জাকসু ভোট তাদের অধিকার ও গণতন্ত্রের চর্চাকে নতুন মাত্রা দেবে।