মোহাম্মদ বেলায়েত শেখ। বাড়ি গাজিপুরের শ্রীপুর। সিলেটের সুনামগঞ্জে নানাবাড়িতে কেটেছে শৈশব। তিন সন্তানের বাবা বেলায়েত দাঁড়িয়ে আছেন জীবনের ৫৫তম বছরে। অবাক করার মতো হলেও সত্য, এ বছর ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেবেন তিনি।
বেলায়েত আগামী ১১ জুন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষধভুক্ত ‘ঘ’ ইউনিটে পরীক্ষা দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনার স্বপ্ন তার। এর আগে তিনি ২০১৯ সালে রাজধানীর বাসাবোর দারুল ইসলাম আলিম মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করেন। তারপর চলতি বছরে ঢাকা মহানগর কারিগরি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন।
জীবনের এই সময়ে এসে এমন একটি সাহসী ও বিস্ময়কর পদক্ষেপ নেয়ার পেছনের গল্পটি ছিল চ্যালেঞ্জিং। বেলায়েত বাংলাদেশ জার্নালকে জানান, নিজের ভাইদের থেকে শুরু করে সন্তানদেরও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করাতে না পারার অবদমিত অভিমান থেকেই এই দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি।
শৈশবকাল থেকে পড়ালেখা করতে গিয়ে সময়ে সময়ে নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছেন বেলায়েত। কখনো অভাব, কখনো বাবার অসুখ, কখনোবা মায়ের অসুখ। সংসারের ভার বহন করতে গিয়ে নিজের পড়াশোনার বয়সটি কবে পার হয়ে যায় তিনি বুঝতেই পারেননি। পরে নিজের সন্তানের সাথেই স্কুলে ভর্তি হন তিনি।
বেলায়েত বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ‘পূর্ব থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল আমি লেখাপড়া করবো। আমার পরিবারেরও ইচ্ছা ছিল এ ব্যাপারে। কিন্তু তখন আমার বাবার সংসারে ছিল অভাব। বাবা খরচ যোগাতে পারেননি। পরে আমি অনেক কষ্ট করে টাকা-পয়সা জমিয়ে নিজের লেখাপড়া করার ব্যবস্থা করি। পরে যখন ১৯৮৩ এর দিকে পরীক্ষা (এসএসসি) দেব তখন আমার বাবা অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাবার চিকিৎসা করাতে গিয়ে আমি আবারো পরীক্ষা দিতে পারিনি।’
এরপরে আরও কিছু বছর কেটে যায়। ১৯৮৮ সালে আবারও পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুত হন বেলায়েত। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, সেবছর বন্যায় ডুবে যায় স্বপ্ন। থেমে যায় বেলায়েতের এসএসি পাশ করা। এরপর আবারও তিনি প্রস্তুতি নেন। আবারও বিফল হন।
বেলায়েত বলেন, ‘৯১-৯২ এর দিকে যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন আবার আমার মায়ের খুব অসুখ। আমার হাতে যা টাকা ছিল সবটুকু চিকিৎসায় ব্যয় করেছি। সেবারও পরীক্ষা দিতে পারিনি। তবে আমার মায়ের অনেক ইচ্ছা ছিল আমাকে পড়ালেখা করাবেন। পরে আমি আমার ভাইদের লেখাপড়ার দিকে নজর দিই।’
তিনি বলেন, ‘তখন তো আমার আর লেখাপড়া করার সময় নেই। ভাইদের একজন এসএসসি পর্যন্ত শেষ করেছে, অন্যজন তাও করেনি। পরে তাদেরকে ব্যবসায় আনি। ওরা ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়।’
তবে এটুকুতেই ক্ষান্ত থাকেননি বেলায়েত। ভাইদের পরে দায়িত্ব নেন নিজের তিন সন্তানকে শিক্ষিত করার। বড় দুই ছেলেমেয়েকে পড়ালেখা করান। কিন্তু তারাও একরকম হতাশ করেন তাকে। কেউই শেষ করেননি অনার্স। তাদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে এমনটিই জানান তিনি।
বেলায়েত বলেন, ‘আমার বড় ছেলে এবং বড় মেয়ে দুইটা করে সেমিস্টার পড়ে আর অনার্স কমপ্লিট করেনি।’
এরপর নিজেই সবকিছুকে পেছনে ফেলে তৈরি হন পড়ালেখার জন্য। পড়ালেখা করার ইচ্ছার ব্যাপারে জানতে চাইলে বেলায়েত শেখ বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ‘মূলত আমার সন্তানদের ওপর পড়ালেখা শেষ না করার অভিমানের উপরেই ভিত্তি করে আমি পড়াশোনা করা শুরু করলাম। আমার ছোট ছেলে যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে আমি তখন গিয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হলাম। তখন আমার বয়স ৫০ বছর। ৫২ বছরে এসে আমি এসএসসি পাশ করি। এসএসসিতে হলো পাই ৪.৪৩; আর এইচএসসিতে ৪.৫৮। দুটো মিলে ৯.১ হয়। যেহেতু ৯ পয়েন্ট উপরে আছে আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এপ্লাই করতে এত লাগে না, তাই ভাবলাম আমি আবেদন করি।’
তিনি বলেন, ‘ছেলে-মেয়েরাও লেখাপড়া করলো না। স্বপ্ন ছিল মেয়েকেও লেখাপড়া করাবো। সেও যেহেতু করেনি তাই আমিও চেষ্টা করলাম। এসব মূলত অভিমান থেকে। আমার ভেতরে যে শিক্ষা অর্জনের একটা ইচ্ছা ছিল সেটা থেকেই আমি মূলত শুরু করেছি। আমার মাসহ সবাই আমার জন্য দোয়া করছেন। আমাকে যে মানুষ এত ভালোবাসছে এটিই আমার সবচেয়ে বড় পাওনা। আমি ‘ঘ’ ইউনিটে আবেদন করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে পড়া আমার স্বপ্ন।’