বিশ্বজুড়ে সবার চোখ আটলান্টিক মহাসাগরের দিকে। এখানেই ১১০ বছরেরও বেশি সময় আগে ডুবে গিয়েছিল সেই সময়ের পৃথিবীর বিস্ময় সৃষ্টিকারী জাহাজ টাইটানিক। সেই জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়ে হারিয়ে গেছে সাবমার্সিবল টাইটান। যানটিতে থাকা ৫ জনের জন্য ৯৬ ঘণ্টার অক্সিজেন ছিল। সেই সময় এরই মধ্যে শেষ হয়েছে।
গত রোববার কানাডার সময় সকাল ছয়টায় (বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪টা) সাগরের নিচে যাত্রা শুরু করে সাবমেরিনটি। এই সময় যানটিতে থাকা ৫ জনের জন্য ৯৬ ঘণ্টার অক্সিজেন মজুদ ছিল। সেই অনুযায়ী সবকিছু ঠিক থাকলে, কানাডার সময় বৃহস্পতিবার সকাল ছয়টা (বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা) পর্যন্ত যানটিতে অক্সিজেন থাকার কথা। সেই সময় এরই মধ্যে শেষ হয়েছে।
তবে চারদিন পার হলেও এখনও ডুবোযানটির সন্ধান মেলেনি। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে খোঁজ চালাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেইসাথে ফিকে হয়ে আসবে সেখানকার পাঁচ আরোহীর জীবিত উদ্ধারের আশা।
মার্কিন উপকূলরক্ষী বাহিনী তাদের অনুসন্ধান এলাকার পরিধি এরিমধ্যে দ্বিগুণ করেছে। উদ্ধারকারীরা রীতিমতো সময়ের সাথে যুদ্ধ করছেন।
সমুদ্রের নীচে টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ এলাকা ঘুরিয়ে আনতে ভ্রমণ পরিকল্পনা করে থাকে ওশানগেট নামের কোম্পানি। আরোহীদের পোলার প্রিন্স নামে জাহাজে করে প্রথমে আটলান্টিকের উপর টাইটানিক ডুবে যাওয়ার জায়গাটায় নিয়ে যাওয়া হয়।
তারপর সেখান থেকে টাইটান নামের ওই সাবমার্সিবল বা ছোট আকারের সাবমেরিনে করে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার গভীরে, টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের মুখোমুখি করা হয়।
এই পুরো সময় সাবটি পোলার প্রিন্স জাহাজের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখে। কিন্তু রবিবার, সাবটি ডুব দেয়ার দুই ঘণ্টার মধ্যে জাহাজের সাথে এর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সবশেষ ডেটা অনুযায়ী সাবটি তিন হাজার আটশ মিটার গভীরে ছিল।
টাইটান যে অঞ্চলটি নীচে নেমেছিল সমুদ্রের স্রোত সেখান থেকে সাবটিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। এই ধারণা থেকে ফ্রান্সের রোবটিক্যালি অপারেটেড ভেহিকল-আরওভি পানির প্রায় চার কিলোমিটার গভীরে পাঠানো হয়েছে। জাহাজটির সমুদ্রের তলদেশে পৌঁছানোর সক্ষমতা রয়েছে বলে জানা যায়।
অভিযানের নেতৃত্বে থাকা ক্যাপ্টেন বলেছেন, ‘সত্যি বলতে, আমরা এখনও জানি না তারা কোথায় আছেন।’
মঙ্গলবার এবং বুধবার সমুদ্রের নীচের ধাক্কা দেয়ার শব্দ পাওয়ার পরই এই তল্লাশি এলাকা আরও বিস্তৃত করা হয়। এখন ১৪ হাজার বর্গ মাইল বা ২২ হাজার ৫৩০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে উদ্ধার তৎপরতা চালানো হচ্ছে। যার পরিধি যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট রাজ্যের আকারের দ্বিগুণ।
টাইটান যে গবেষণা জাহাজ থেকে ছেড়ে গিয়েছিল সেই পোলার প্রিন্সে অনুসন্ধানের জন্য কমান্ড সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। এটি টাইটানিকের ধ্বংসস্তূপের কাছাকাছি বসে উদ্ধার তৎপরতা তদারকি করছে। ক্যামেরা-সজ্জিত রিমোট-নিয়ন্ত্রিত বাহন আরওভি সমুদ্রতলের গভীরে স্ক্যান করছে।
জাহাজে থাকা পাঁচ যাত্রীর মধ্যে রয়েছেন ব্রিটিশ ধনকুবের ৫৮ বছর বয়সী হামিশ হার্ডিং, ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ৪৮ বছর বয়সী শাহজাদা দাউদ, তার ছেলে ১৯ বছর বয়সি ছাত্র সুলেমান দাউদ, ৭৭ বছর বয়সী ফরাসি অভিযাত্রী পল-হেনরি নারজিওলেট এবং ওশানগেটের প্রধান নির্বাহী ৬১ বছর বয়সী স্টকটন রাশ। আরোহীদের মধ্যে নারজিওলেট, টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখার অভিযানে আগেও অংশ নিয়েছেন।
অক্সিজেন একমাত্র সমস্যা নয়
একটি ২২ ফুট সাবে সাবমার্সিবলে এতো সময় ধরে পাঁচ জন মানুষ আটকে পড়ায় তাদের ক্লাস্ট্রোফোবিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
নিউফাউন্ডল্যান্ডের সেন্ট জনস-এর মেমোরিয়াল ইউনিভার্সিটির হাইপারবারিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. কেন লেডেজ বলেন, বাতাস ফুরিয়ে যাওয়াই এখন একমাত্র বিপদ নয়।
ডুবোজাহাজটি বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। এই বিদ্যুৎ অক্সিজেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ার সাথে সাথে ভিতরের সবার প্রশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসা কার্বন ডাই অক্সাইডের হার বেড়ে যাবে, যা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।
তিনি বলেন, ‘কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বাড়ার সাথে সাথে এটি চেতনানাশক গ্যাসের মতো কাজ করে। যার প্রভাবে মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে।’
একজন ব্যক্তির রক্তপ্রবাহে হাইপারক্যাপনিয়া নামে গ্যাস অত্যধিক পরিমাণে বেড়ে গেলে এবং দ্রুত চিকিৎসা না করালে মানুষ মারা যেতে পারেন।
সাবেক রয়্যাল নেভি সাবমেরিন ক্যাপ্টেন রায়ান রামসে বলেছেন যে তিনি টাইটানের ভিতরের ভিডিওগুলি অনলাইনে দেখেছেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণ ব্যবস্থা দেখতে পাননি, যা স্ক্রাবার নামে পরিচিত।
তার মতে, সাবটি সমুদ্রতটে থাকলে পানির তাপমাত্রা প্রায় শূন্যে নেমে আসবে। যদি এর বিদ্যুৎ চলে যায় তাহলে এটি ভেতরের পরিবেশ উষ্ণ রাখতে পারবে না। ফলে হাইপোথার্মিয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাবে। অর্থাৎ শরীর খুব ঠান্ডা হয়ে যাবে।
সাব-এর মধ্যে অক্সিজেনের অভাব এবং কার্বন ডাই অক্সাইড জমা হওয়া মানে ভেতরের আরোহীদের উদ্ধারকারীদের সাথে যোগাযোগ করার ক্ষমতা, যেমন নিয়মিত বিরতিতে হুলের উপর আঘাত করার ক্ষমতা হ্রাস পাবে।