Imam Hossain
নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া বাঙালি নারীদের কাছে একটা অনুপ্রেরণা। সীমাবদ্ধতার মাঝেও নিজেকে মানুষের জন্য গড়ে তোলা, দেশের জন্য চিন্তা করা এখনকার নারীদের কাছে একটা মুখ্য বিষয়। সেই নারীদের মাঝে নিশাত আনজুম সেমন্তী হয়ে উঠতেছেন এক অনুপ্রেরণার নাম। নারী কোনো সীমাবদ্ধতায় আটকায় নাহ, সেমন্তী যেন তারই একটা জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ।
কাজী নিশাত আনজুম সেমন্তী, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগে পড়শোনা করছেন। তার বেড়ে ওঠা কুষ্টিয়ায়। ছোট জেলায় তখন সুযোগ সুবিধা ছিল তুলনামূলক কম, তারমধ্যে মেয়েদের এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিজে অংশগ্রহণ ছিলো আরো কম।
স্কুলজীবনে তিনি ঠিক করেন বিতর্ক করবেন। নানা প্রতিকূলতায় বিতর্ক শুরু করেন তিনি । স্কুলে বিতর্ক ক্লাব গড়ে তোলার পাশাপশি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক জায়গা থেকে নেতৃত্ব চর্চা শুরু করেন।
স্কুলে থাকা অবস্থায় একটা কথা প্রায়ই শুনেছিলেন , স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য জেলার যেকোনো আয়োজন মানেই সেমন্তী পুরষ্কার নিয়ে যাবে। বিতর্ক, আবৃত্তি, রচনা লেখা, বিজ্ঞান উৎসব বা অলিম্পিয়াড সব কিছুতেই অংশগ্রহণ ও অর্জন চলে।
এরপর আরো বেশি সুযোগের আশায় কলেজের জন্য ঢাকায় চলে আসেন । বড় শহরে তাল মেলাতে কিছুটা সময় চলে গেলেও জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনে অর্জনে ভাটা পড়েনি।
ছোট থেকেই ইচ্ছা ছিল মানুষের জন্য কাজ করবেন । তার কাছে মানুষের মুখের হাসি অনেক দামি। করোনা মহামারির সময় কাজের সুযোগটা যেন বড় করে আসে। সম্মুখযোদ্ধা না হয়েও নিজের শারীরিক সীমাবদ্ধতা থাকায় ঘরে বসেই ফান্ড রাইজিং, টিম ম্যানেজমেন্ট, লেখালেখি শুরু করেন ।
শুরুর দিকে ‘প্রজেক্ট ঘর’ নিয়ে কাজ করা সেমন্তীকে অন্যরকম অনুভূতি দেয়। যখন প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের সাথে কথা বলতো তাদের জীবনের গল্প গুলো মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য, বারবার মনে ধাক্কা দিয়ে যেত তার টিমের।
সবশেষে তারা ফান্ড কালেক্ট করতে সক্ষম হয় এবং আম্ফান ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের নতুন স্বপ্ন, নতুন ঘর তুলে দিতে সক্ষম হয়। এভাবেই চলতে থাকে তাদের স্বেচ্ছাসেবী কাজ। এসব কাজের বিনিময়ে তিনি পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা৷
একবার গ্রামীণ নারীদের সম্মাননায় তারা একটা প্রোগ্রাম আয়োজন করেন। সদূর পার্বত্য অঞ্চলের একজন নারী তার জন্য তাদের হাতে করা স্পেশাল অর্নামেন্টস নিয়ে আসেন। নিজে হাতে পরিয়ে দেন। এই ভালোবাসা গুলোই তার কাজের অনুপ্রেরণা।
সেক্স ওয়ার্কার, ট্রান্সজেন্ডার, হিজড়া সম্প্রদায়কেও নিয়ে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের নতুন কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছেন এই তরুণী।
শিক্ষা এবং শান্তি এই দুইটা বিষয় বরাবর ভাবায় সেমন্তীকে । তরুণদের মধ্যে শান্তি, সহমর্মিতা বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে ‘লাস্ট মাইল লাইফের’ দায়িত্ব গ্রহণ করেন ।
এছাড়াও তৃতীয় লিঙ্গের একজন আপার পরিচালিত ঢাকার মুগদার বস্তি এলাকার একটা স্কুলে তিনি বাচ্চাদের বিভিন্ন সেশন পরিচালনা করে থাকেন নিজ উদ্যোগে। সেখানেও বাচ্চাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশিক্ষণের আয়োজন করেন সেমন্তী।
পরবর্তীতে ‘Zened’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার কাজ আরও জায়গা প্রসারিত করেছেন। সংগঠণটি কিশোর ও তরুণদের মধ্যে রেসিলেন্স বৃদ্ধি, এই ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের জন্য যোগ্য নাগরিক গড়ে তোলা বা উন্নত চিন্তাধারার বিকাশে কাজ করছে। খুব দ্রুত তারা ঢাকার বাইরে কাজের পরিসর বৃদ্ধি করার চিন্তা করছে।
নেতৃত্ব এবং সেমন্তী এক ও অভিন্ন। বিভিন্ন সংগঠণে পালন করেছেন গুরু দায়িত্ব। কুষ্টিয়া ডিবেটিং সোসাইটির প্রথম নারী সভাপতি হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টারে, প্রফেশনাল ডেভেলোপমেন্ট ফ্যাসিলিটেটর হিসেবে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের তরুণদের স্কিল গঠণেও কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে সেমন্তীর অভিজ্ঞতার ঝুলিতে। বর্তমানে থিসিস নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন পাশাপাশি বাংলাদেশি ইমিগ্রেন্টদের জন্য একটি প্লাটফর্ম “বাংলা বুলেটিন”এ কাজ করছেন ‘লিড কনটেন্ট আর্কিটেক্ট হিসেবে।
কাজের পাশাপাশি তিনি অর্জন করেছেন বেশ কিছু সম্মাননা। বিভিন্ন বিতর্ক প্রতিযোগিতা, উপস্থিত বক্তৃতা ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় নিয়মিত নিজের অর্জনের ঝুলি ভারি করছেন। ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক যুব দিবসে Global Law Thinkers Society থেকে “শ্রেষ্ঠ নারী নেত্রী” এর খেতাব অর্জন করেন। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বিতর্ক প্রতিযোগিতা, Mujib -100 MDC Mixup 1.0 তে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের” নারী দিবস বিতর্ক-২০২০” আয়োজনে রানার আপ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০২১ এ “পলিসি ক্যাম্প ২০২১” এর বিজয়ী হয়েছিলেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংগঠণের শ্রেষ্ঠ সংগঠকের খেতাব অর্জন করেন।
নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন সেমন্তী। তিনি বিশ্বাস করেন যে নারীদের অগ্রযাত্রায় নানা ধরনের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। মেয়েদের অর্জন, নেতৃত্ব এখনো প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। তবে পরিবারের সাপোর্টে এই জার্নিটা তাকে সহজ করেছে। ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাবেন এটাই প্রত্যাশা।