রনবীর চন্দ্র রায়, ফুলবাড়ী উপজেলা প্রতিনিধি।।
মেয়ে আমি সমানে সমান,মেয়ে শিশু বোঝা নয়, সুযোগ দিলেই সম্পদ হয়। এই প্রতিপাদ্য কে সামনে রেখে নিজের বুদ্ধি মত্তাকে কাজে লাগিয়ে বিবিএফজি মাঠ কর্মীর সহযোগিতায় বাবা,মাকে বুঝিয়ে নিজের বাল্য বিবাহ ঠেকিয়ে এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন,৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া বুদ্ধিমতি প্রতিবাদী শিক্ষার্থী কুমারী অনামিকা রানী।তারপর থেকে এই অল্প বয়সী মেয়ে নিজেকেই সংগ্রামী ও প্রতিবাদী হিসেবে গড়ে তুলতে আর থেমে থাকতে হয়নি তখন থেকে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ সহ-সমাজের অবহেলিত মেয়ে শিশুদের নিয়ে সে একাধারে কাজ করে যাচ্ছে আজ অবধি।
জানা যায় কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার সিমান্ত ঘেঁষা কাশিপুর ইউনিয়নের সাত নং ওয়ার্ডের আজোয়াটারী গ্রামের অনিল চন্দ্র রায় ও ফাল্গুনী রানীর সেই সাহসী কন্যা প্রগতিশীল শিক্ষার্থী কুমারী অনামিকা রানী। সরেজমিনে গিয়ে প্রতিবাদী শিক্ষার্থী অনামিকা রানীর সাথে কথা বললে সে প্রতিবেদক কে জানায় তার জীবনের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প: ২০১৬ সালে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-4,25 পেয়ে উত্তীর্ণ হয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় ২০১৭ সালে আমার বাবা-মা অন্যের প্ররোচনায় আমার বাল্যবিবাহ দেওয়ার উদ্যোগ নেয়, কিন্তূ আমার কোনভাবেই বিয়েতে মত ছিল না এই কথাটি তাদেরকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে পরি কি করব বুঝে উঠতে পারছিনা,সে সময়ে আমাদের এলাকায় প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের বিবিএফজি প্রজেক্টের কাজ সাময়িক কর্মশালা শুরু হয়েছে, পরস্পরের জানতে পারি এই প্রজেক্টটির কাজ বাল্যবিয়ে বন্ধ করা,এরেই মধ্যে একদিন বিবিএফজি (বিল্ডিং বেটার ফিউচার ফর গার্লস)প্রজেক্টের মাঠ কর্মী আন্টির সাথে আমার পরিচয় ঘটলে তার সরণাপন্ন হয়ে আমার বাল্যবিবাহের কথা ওনাকে বলি তখন উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন চিন্তা করিও না “মা”আমি তোমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলব। অবশ্য তখন মাঠকর্মী আমাদের মতো তরুনদের খুঁজছেন এবং চ্যাম্পিয়ন ফাদার -মাদার নির্বাচিত করার চেষ্টা করে আসছেন।
পরবর্তীতে উনি বাবা-মায়ের সাথে দেখা করে আমার মতামত গুলি প্রকাশ সহ-বাল্য বিবাহের সুফল কুফল নিয়ে আলোচনা করে বাবা-মাকে বোঝাতে সক্ষম হলে বাবা বিয়ে দেওয়া অবস্থান থেকে ফেরত আসে। উনি বাবাকে আরোও বলেন আপনার যেহেতু দুইটিই মেয়ে সন্তান সে হেতু আপনাকে এই ০৭ নং ওয়ার্ডের চ্যাম্পিয়ন ফাদারের দায়িত্ব নিতে হবে প্রস্তাবে বাবা রাজি হন তখন মাঠকর্মী বলেন আপনি অন্যান্য ওয়ার্ডের এই রকম তথ্য গুলো আমাদের কে দিয়ে কাজ করার সুযোগ করে দিবেন।
তারপর থেকে বাবা আমাকে সেই প্রজেক্টে যাওয়ার সুযোগ করে দিলে প্রতিটি প্রশিক্ষণে মাসিক মিটিংএ নিয়মিত সদস্য হয়ে উঠি, এদিকে বাবা-মা আমাকে নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। সেই থেকে বাবা আমাদের দুই বোনকে ছেলে সন্তানের চেয়ে ছোট করে দেখেন না। এরপর থেকে বাবা-মে আর থেমে থাকিনি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আশেপাশে তুমুল ভাব সচেতনতা সৃষ্টি করি। পরবর্তীতে বাবা চ্যাম্পিয়ন ফাদার হিসেবে জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে দেন ইউনিয়ন থেকে উপজেলা পর্যায়ে। তারপর থেকে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের আওতাধীন বিবিএফজি প্রজেক্ট থেকে জীবনের সুস্থ সুন্দর যাত্রা শুরু হয় আমার সেখান থেকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি যেমন জীবন দক্ষতা নেতৃত্ব দেওয়া নিজেকে প্রগতিশীল হিসেবে তৈরি করা সহ-বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে নেতৃত্বদানের সক্ষমতা অর্জন করি এবং নতুন করে জীবনকে গড়তে পথ-চলা শুরু হয় আমার।
এরপর থেকে থেমে থাকিনি আমি সমাজের কুসংস্কার ও ভয়ভীতি কে তুচ্ছ করে নিজের অধিকার আদায় লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে শিখি মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে মেয়ে শিশুদের নিয়ে ক্যাম্পেইন,রেলী সহ-বিভিন্ন প্রকার সচেতনামূলক সেশন পরিচালনা করতে থাকি, শিশু সুরক্ষা নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বার এবং কাজি,পুরহীত দের সাথে আলোচনা করি।জন্মসনদ নিশ্চিত করন এবং মেয়েদের জন্ম অভ্যার্থনায় অংশগ্রহণ করি, সমাজে ধর্ষণ প্রতিরোধে বিট পুলিশীং সমাবেশে নেতৃত্ব দানকরি,বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে লিফলেট বিতরণ সহ- প্রত্যেক্ষ পরোক্ষভাবে ভাবে বাল্যবিবাহ রোধ করে আসছি,বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে প্রতিটি ইউনিয়নে”আদালত বিতর্ক” উপস্থাপন করেছি।
২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সালের কিছুদিন বিবিএফজি প্রজেক্টের কার্যক্রম Plan International কর্তৃক অব্যাহত রাখেন।পুনরায় ২০২২ এর শেষদিকে Child not Bride (CNB) প্রজেক্ট এই মেয়ে সন্তানদের ইস্যু নিয়েই Plan International Bangladesh এর আওতাধীন আবারো কার্যক্রম শুরু করলে তাদের সাথে হাতে হাত রেখে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে গার্লস লীডারশীপ-২০২৩ এ অংশ গ্রহণ করে বক্তৃতার মাধ্যমে আমি আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছিলাম।সেই অনুষ্ঠানে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে যুক্ত ছিলেন,Plan International Bangladesh এর প্রধান স্যার, কবিতা বোস ম্যাডাম সহ-আরো অন্যান্যরা সেই অনুষ্ঠানে সার্টিফিকেট ও অন্যান্য পুরস্কার প্রাপ্ত হই। অন্যদিকে নারীর ক্ষমতায়নে গার্লস টেক- ওভার ২০২৪-এ অংশ গ্রহণ করে আমাদের জেলায় একদিনের জন্য পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করেছিলাম,সেখানেও ক্রেষ্ট সহ-অন্যান্য পুরুস্কার গ্রহণ করি। গার্লস লীগারশীপ ২০২৩ ও গার্লস টেক-ওভার ২০২৪ এ অংশগ্রহন করে আরো সক্ষমতা বেড়ে যায়।
শুধু এইটাতে থেমে থাকিনি আমি শিশুবিষয়ক অসংখ্য প্রোগামে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে আত্মবিশ্বাসী ও সাহসী বালিকা হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি। সমাজে অবহেলিত মেয়েদের জীবন সুন্দর করতে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছি,এটি অব্যাহত থাকবে আমার।সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার নামই জীবন।আর সেই জীবন যুদ্ধের একটু ব্যাতিক্রম হিসেবে নিজের জীবনটাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে গড়ে তুলেছি ছোট বেলা থেকেই প্রতিবাদমুখর ছিলাম আমি, চারপাশে যখন দেখতাম আমার মতো মেয়ে শিশুদের নিয়ে পরিবার কিংবা সমাজের লোকজনের তিরস্কার,অবহেলা করতে তখন নিজেকে সহ্য করতে পারতাম না,সেই জলন্ত চেতনার মধ্যে দিয়েই তৈরি হয় অবহেলিত মেয়ে শিশুদের নিয়ে কাজ করার ভাবনা। পড়াশুনার পাশাপাশি মেয়ে শিশুদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি,একই সাথে আমি বিভিন্ন কো-কারিকুলাম কার্যক্রমে অংশ গ্রহণ করে পুরস্কার গ্রহণ করেছি, যেমন কবিতা আবৃত্তি, সংগীত ,একক অভিনয়,বিতর্ক প্রতিযোগিতা কুইজ,ভাষা ও সাহিত্যে এবং বিজ্ঞান বিষয়ে স্কুল, কলেজ উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে অংশগ্রহণ বিভিন্ন ক্রেষ্ট ও সার্টিফিকেট,অসংখ্য বই সহ- বিভিন্ন পুরস্কার প্রাপ্ত হয়েছি।
আমি ২০১৯ সালে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় জিপিএ -4,50 পেয়ে উত্তীর্ণ হয়ে ২০২২সালে (এসএসসি) পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ -5,00 পেয়ে উত্তীর্ণ হই, এবছর ২০২৪ সালে (এইচএসসি) পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ -4,58 পেয়ে উত্তীর্ণ হই।পড়াশোনা সহ -সব কিছুতেই আমার পাশে বাবা ও মায়ের সাপোর্ট ছিল,তারা পাশে ছিল বলেই আমি এতদূর পর্যন্ত এসেছি।আমি এখন Plan International Bangladesh এর (CNB) project এর পাশাপাশি জলবায়ু ইস্যু নিয়ে Actionaid Bangladesh এর Global platform এ কাজ করে যাচ্ছি,যেহেতু আমাদের বাংলাদেশ জলবায়ু ভাবাপন্ন। অন্যদিকে RDRS বাংলাদেশের্যর সাথে মেয়ে শিশুর ইস্যু নিয়ে কাজ করছি।এক কথায় আমি একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে আমার স্বপ্ন পুরণ করে সকলের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাই,এবং সমাজের অবহেলিত মেয়ে শিশুদের নিয়ে সর্বদা কাজ করে যেতে চাই।