জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দলের প্রতিবেদনে ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময়ে বাংলাদেশে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চলা এই গণঅভ্যুত্থানে ১ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করার সম্ভাবনাও উঠে এসেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) সত্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে।
‘বাংলাদেশে জুলাই ও আগস্ট ২০২৪-এ সংঘটিত প্রতিবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অবমাননা’ শীর্ষক প্রতিবেদনটির তথ্যকে উপজীব্য করে আজ বুধবার ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে প্রতিবেদন করেছে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজি ভাষার গণমাধ্যমগুলো। এর মধ্যে আছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি, কাতারভিত্তিক আল জাজিরা, রাশিয়ার আরটিএন, ভারতের দ্য হিন্দু ও ইনডিয়া টুডে, পাকিস্তানের দ্য এক্সপ্রেস টুডেসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম।
‘ক্র্যাকডাউন অন বাংলাদেশ প্রোটেস্টার্স মে বি ক্রাইম অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটি, ইউএন সেইস’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি, যা বাংলা করলে দাঁড়ায়– ‘বাংলাদেশের বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কঠোরতা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, বলেছে জাতিসংঘ’।
এ বিষয়ে বিবিসি বাংলার করা প্রতিবেদনের শিরোনাম– জুলাই আন্দোলন দমনে সমন্বয়ের নেতৃত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা)।
আল জাজিরার শিরোনাম– ‘ফরমার বাংলাদেশ গভট বিহাইন্ড পসিবল “ক্রাইম অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটি”, সেইস ইউএন’। অর্থাৎ, ‘বাংলাদেশের বিগত সরকার ‘‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’’ করে থাকতে পারে, বলেছে জাতিসংঘ।’
রাশিয়ার টিআরটি ওয়ার্ল্ডের শিরোনাম– ‘চিলড্রেন্ এমোং ‘‘হানড্রেডস অব এক্সট্রাজুডিসিয়াল কিলিং’’ আনডার হাসিনা: জাতিসংঘ’। অর্থাৎ, ‘হাসিনার অধীনে ‘‘শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকারদের’’ মধ্যে শিশুরাও: জাতিসংঘ’।
ইনডিয়া টুডে শিরোনাম করেছে ‘শেখ হাসিনা রেজিম বিহাইন্ড পসিবল ‘‘ক্রাইম এগেইন্সড হিউম্যানিটি’’ ডিউরিং প্রোটেস্টস: ইউএন’। অর্থাৎ, ‘বিক্ষোভের সময় সম্ভাব্য ‘‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’’ পেছনে শেখ হাসিনার শাসন: জাতিসংঘ’।
ভারতের আরেক গণমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসের শিরোনাম, ‘ইউএন একিউজেস ফর্মার শেখ হাসিনা গভট অব পসিবল ‘‘ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটি’’ ইন বাংলাদেশ।’ অর্থাৎ, ‘জাতিসংঘ বাংলাদেশে সম্ভাব্য ‘‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’’ জন্য বিদায়ী শেখ হাসিনা সরকারকে অভিযুক্ত করেছে’।
পাকিস্তানের ‘দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন’ শিরোনাম করেছে, ‘ইউএন একিউস শেখ হাসিনাস গভর্নমেন্ট অব ওয়াইডস্প্রেড হিউম্যান রাইটস ভায়োলেশনস ইন বাংলাদেশ’। অর্থাৎ, ‘জাতিসংঘ শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে।’
প্রসঙ্গত, জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে ১২ থেকে ১৩ শতাংশই ছিল শিশু। বাংলাদেশ পুলিশ জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে তাদের ৪৪ জন কর্মকর্তা রয়েছে। এছাড়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময়ে হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে বলেও জানিয়েছে জাতিসংঘ। প্রতিবেদনে জাতিসংঘ বলছে, আহতরা বাংলাদেশের নিরাপত্তাবাহিনীর গুলিতে আহত হয়েছে।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহিংস উপাদানগুলোর গত বছরের ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের সময় পদ্ধতিগতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিল।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, যারা সরাসরি বিক্ষোভ পরিচালনার সঙ্গে জড়িত ছিল এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো জানিয়েছে কীভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের কর্মকর্তারা একাধিক বৃহৎ আকারের অভিযানের নির্দেশনা দেন ও তদারকি করেন। যেখানে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের গুলি করে হত্যা করেছিল বা নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করেছিল।
এতে দেখা গেছে, নিরাপত্তা বাহিনী পরিকল্পিতভাবে এবং অবৈধভাবে বিক্ষোভকারীদের হত্যা বা পঙ্গু করার সঙ্গে জড়িত ছিল। এর মধ্যে এমন ঘটনাও ছিল, যেখানে বিক্ষোভকারীদের বিন্দু-শূন্য পরিসীমা থেকে গুলি করা হয়েছিল।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেন, ‘এই নৃশংস প্রতিক্রিয়া ছিল সাবেক সরকারের একটি পরিকল্পিত এবং সমন্বিত কৌশল, যা জনতার বিরোধিতার মুখে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে চেয়েছিল। বিক্ষোভ দমন করার কৌশলের অংশ হিসেবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে, তাদের সমন্বয় ও নির্দেশনায় শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ব্যাপক নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও আটক এবং নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে।’
ভলকার তুর্ক আরও বলেন, ‘আমরা যে সাক্ষ্য এবং প্রমাণ সংগ্রহ করেছি তা ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সহিংসতা এবং লক্ষ্যভিত্তিক হত্যাকাণ্ডের এক উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর এবং যা আন্তর্জাতিক অপরাধও গঠন করতে পারে। জাতীয় নিরাময় এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য দায়বদ্ধতা এবং ন্যায়বিচার অপরিহার্য।’
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের অনুরোধে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে একটি দল পাঠায়, যার মধ্যে মানবাধিকার অনুসন্ধানকারী, একজন ফরেনসিক চিকিৎসক এবং একজন অস্ত্র বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যাতে মরণঘাতী ঘটনাগুলোর বিষয়ে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তথ্য অনুসন্ধান পরিচালনা করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার তদন্তের ব্যাপারে ব্যাপক সহযোগিতা করেছে, অনুরোধকৃত প্রবেশাধিকারের অনুমতি দিয়েছে এবং যথেষ্ট নথিপত্র সরবরাহ করেছে।