মো: আহসানুল ইসলাম আমিন, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক :
মুন্সিগঞ্জ জেলা সদরে ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী সরকারী হরগঙ্গা কলেজে ক্যাম্প স্থাপন করেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে নিরীহ বাঙ্গালিদের ধরে এনে এই ক্যাম্পে নির্যাতন করার পাশাপাশি নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। এই বধ্যভূমির স্থলেই বহু মানুষগুলোকে মাটি চাপা দেয়া হয়েছিলো । যা আজ বধ্যভূমি ও গণকবর হিসেবে পরিচিত। এই বধ্যভূমি পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার অভাবে ঝোপ ঝাড় ও জঙ্গলের পরিনত হয়েছে হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তারা জানান, প্রতি বছর ডিসেম্বর মাস এলেই বধ্যভূমির চারপাশের দেয়ালে রঙ করার পাশাপাশি বধ্যভূমির অভ্যন্তরে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার ছোঁয়া লাগে। চারপাশের দেওয়ালে আর স্তম্ভে দেওয়া হয় রংয়ের প্রলেপ তারপর বিশেষ দিনে অর্পণ করা হয় পুষ্পস্তবক এরপর আর কেউ খবর রাখে না এই বধ্যভূমির। রাত পোহালে মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বর । বধ্যভূমি চারপাশ ও চত্বরে পচা পাতা, আর বিভিন্ন ধরনের আগাছার লতাপাতায় ঘন জঙ্গলে পরিণত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভটি। দিনে রাতে বধ্যভূমিতে মাদকসেবীদের আড্ডা স্থলে পরিনত হয়। ঝোপ ঝাড়ের কারণে নির্জন এই জায়গাটিকে এখন মাদকসেবীরা মাদকসেবনের সুবিধাজনক জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছে। বহিরাগত লোকজন অনায়েসে উন্মুক্ত গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করছেন বলেও জানিয়েছেন স্থানীয়রা। স্থানীয় সচেতন নাগরিকদের অভিযোগ, বধ্যভূমিটি অরক্ষিত অবস্থায় থাকার কারণে সেখানে মাদকসেবীদের আড্ডা বেড়ে গেছে। বধ্যভুমির ভিতরে থাকা ঝোপ ঝাড়ের আড়ালে বসে মাদকসেবন করেন মাদকসেবীরা। শুধু তাই নয়, মাদকসেবনের পর ফেন্সিডিলের খালি বোতলগুলো যেখানেই ফেলে রেখো যাচ্ছে সেবনকারীরা।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বধ্যভুমির মূল গেটের ছোট গেটটি খোলা রয়েছে। সেখানে নেই কোন তালা। ভিতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে ঝোপ ঝাড় । যেখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফেন্সিডিলের খালি বোতল। বধ্যভূমির মূল ব্যাধির চারপাশে ও স্মৃতিস্তম্ভটির যেখানে সেখানে বিড়ি, সিগারেট, ইয়াবা ও গাঁজা সেবনে ব্যবহৃত বস্তু পড়ে আছে। লতাপাতা আর ঝোপ ঝাড়ে ভরে গেছে স্মৃতিস্তম্ভটি । অনেকটা অরক্ষিত অবস্থায় বধ্যভূমিটি পড়ে আছে।ঝোপ ঝাড়ে ভরে গেছে পুরো বধ্যভূমির স্মুতির ফলকের চারপাশ। যেখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফেন্সডিল ও মাদকসেবীদের রেখে যাওয়া চিহ্ন।
সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মো. নাজমুল হাসান সোহেল বলেন, বিষয়টি অত্যান্ত হৃদয় বিধারক যেটি আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আমাকে দারুনভাবে মর্মাহত এবং আহত করেছে। সেটি হচ্ছে এই বধ্যভূমিটিতে জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বস্থরের মানুষ শদীর বুদ্ধীজীবিদের শ্রদ্ধা জানাতে আসি। বধ্যভূমিটি অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে। বধ্যভুমিতে প্রচুর পরিমানে ফেন্সিডিলের খালি বোতল এদিকে সেদিক পড়ে আছে। এখানে একটি গেট রয়েছে সেই গেটে তালা নেই। এখানে অনায়েসে মাদকসেবীরা ঢুকে মাদকসেবন করেন। তিনি আরো বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা বিশাল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মাদক নির্মল করা। এই রকম যদি অবস্থা হয় তাহলে কিভাবে মাদকমুক্ত সমাজ হবে ?। আমি একজন জনপ্রতিনিধি ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে বলতে চাই উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আনিছুজ্জামান আনিছ তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা । পাশাপাশি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আছেন তারা যেন এই বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসকের সাথে পরামর্শ করেন । যাতে দ্রুত সময়ে এই বধ্যভূমিটির সুরক্ষা ও পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মো. শাহজান গাজী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের যে স্মুতিগুলো এবং মুক্তিযুদ্ধের যে অবদানগুলো যেখানে যেখানে আছে সেগুলোর স্মুতি ধরে রাখার জন্য বিভিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। অত্যন্ত দু:খ এবং পরিতাপের বিষয় হচ্ছে আমি আজকে এখানে এসে দেখলাম জায়গাটিতে মাদকের বিভিন্ন চিহ্ন লক্ষ্য করা গেছে। ফেন্সিডিলের বোতল ও মাদকে সেবনের বিভিন্ন আলামদ পড়ে আছে। ঝোপ ঝাড় থাকার কারণে এখানে এসে মাদকসেবীরা আড্ডা দেয়। তিনি আরো বলেন, আমরা আশা রাখবো ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবি দিবস। সেই দিনটি উপলক্ষ্যে ১ দিনের জন্য পরিস্কার না করে সারাবছর যাতে এটা পরিচ্ছন্ন থাকে সেই ব্যবস্থা করা হয়। বধ্যভূমির যে স্মুতি যদি না থাকে মানুষ তথা নতুন প্রজন্ম যারা আছেন তারা কি শিখবে ? । কারণ এই স্মুতিগুলো দেখেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানবে। কিন্তু এই বধ্যভূমিতে এসে যে পরিস্থিতি দেখলাম এখানে আসবে কে এই ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে। এখানে আসার কোন পরিবেশ নেই। আমার দাবি থাকবে, এই স্থাপনাটি যেন সংরক্ষিত করা হয়। সুন্দরভাবে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা হয়।
সরকারী হরগঙ্গা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আব্দুল হাই তালুকদার বলেন, সরকারী হরগঙ্গা কলেজ সংলগ্ন যে বধ্যভূমি সেই বধ্যভূমিতে আমরা বছরে একদিন ১৪ই ডিসেম্বর আমরা ফুল দিয়ে শদীদ বুদ্ধিজীবিদের শ্রদ্ধা নিবেদন করি। কিন্তু তার আগে এবং পরে বধ্যভূমিটি সম্পূর্ণ অসুরক্ষিত থাকে। এমনকি এটার যে মূল গেট রয়েছে সেটা উন্মুক্ত থাকে। যার কারণে বাইরের লোকজন এসে মাদকসেবন করেন। জায়গা নির্জন হওয়াতে মাদকসেবীরা মাদকসেবনের জন্য এই জায়গাটি বেছে নিয়েছে। আমি আমার কলেজের শিক্ষকদের নিয়ে দু”একটি অভিযান করেছি। তিনি আরো বলেন, যখন দেখছি কোনভাবেই বাইরের লোক আসা বন্ধ হচ্ছেনা তখন টহল দেয়ার জন্য পুলিশকে বলেছিলাম। আইনশৃংখলার একটি মিটিংয়েও এই কথাটি উল্লেখ করেছিলাম। কিন্তু তারপরও বধ্যভূমির গেটটি সেটি খোলা থাকে। ছাত্র ছাত্রীরা সেখানে দিনের বেলাতেই মাদক গ্রহন করে। নিরুপায় হয়ে আমি আমাদের কলেজকে রক্ষা করার জন্য আমাদের কলেজের এরিয়াটা টিন দিয়ে বেড়া দিয়ে দেই।মাদকসেবীর কবল থেকে আমাদের প্রতিষ্ঠানকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করেছি। এই বিষয়টি আমাদের আইন শৃংখলা বাহিনী বা প্রশাসন যাতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি আরোও বলেন, এই বধ্যভূমিটা একেবারেই অরক্ষিত অবস্থায় আছে। কয়েক বছর ধরে দেখছি ১৪ ডিসেম্বর আসার আগে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়। বাকী সময়গুলোতে তেমন যত্ন নেয়া হয় তেমন কোন নজির আমার চোখে পড়েনি। বধ্যভূমিটিতে যেন বাইরের লোক ঢুকতে না পারে এমন ব্যবস্থা করলে এটা সুরক্ষিত থাকবে। অরক্ষিত ,পরিস্কার পরিচ্ছন্ন এবং মনিটরিং এর আওতায় না থাকলে সেই জায়গাটি নির্জন স্থানে পরিনত হয়। সেই জায়গায় বিভিন্ন রকমের অসামাজিক কাজ ম্দাক এমনকি খুন খারাপি ঘটতে পারে। সেই জন্য আমার মনে হয় যাদের তত্বাবধানে বধ্যভূমিটি দেখাশোনার করার দায়িত্ব আছে, তারা যদি এই কাজটি এটা করে তাহলে কোন ধরনের বিপদ ও মাদকসেবনের মতো খারাপ কাজ ঘটনার সম্ভবনা থাকেনা।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অপরাধ ও প্রশাসন সুমন দেব বলেন, ওখানে কারা আসে যায় বা কি করে সেই এটা আমরা তদন্ত করে দেখবো। কারও বিরুদ্ধে মাদক সম্পৃক্ততার কোন অভিযোগ পাওয়া যাবে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ম্যাজিস্ট্রেট শীলু রায় বলেন, হরগঙ্গা কলেজের বধ্যভূমিতে মাদকসেবীদের আড্ডা সেটা আজকেই জানলাম। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।