শফিকুল ইসলাম সোহেল ,শরীয়তপুর প্রতিনিধি
আজ ২৩ শে ডিসেম্বর জাতীয় বীর আব্দুর রাজ্জাকের ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১১ সালের এই দিনে দীর্ঘ রোগ ভোগের পর লন্ডনের কিংস কলেজ হাসপাতালে ৬৯ বছর বয়সে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম এই খ্যাতিমান পুরুষ মৃত্যুবরণ করেন। আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা, গোসাইরহাট ও ভেদরগঞ্জ আওয়ামী লীগ,যুবলীগ,ছাত্রলীগ,সেচ্ছাসেবকলীগ ও আমার রাজ্জাক সেচ্ছাসেবী সংগঠন সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বিশেষ দোয়া ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক আব্দুর রাজ্জাককে বলা হতো বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মানসপুত্র। তিনি ছিলেন অসামপ্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসীদের বাতিঘর। আব্দুর রাজ্জাকের রাজনৈতিক জীবনে রয়েছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন অকুতভয় সৈনিক হয়ে বাঙালী মুক্তি আন্দোলনের অগ্রসৈনিক হিসেবে লড়াই করে গিয়েছেন। তার জীবনাতিহাস এদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাসের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জরিত। আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে কথা বলতে গেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে বলতে হবে সবার আগে।
১’শ ৯০ বছরের ইংরেজ ঔপোনিবেশিক দুঃশাসনের পরিসমাপ্তি শেষে ১৯৪৭ সালের মধ্যভাগের পর দ্বি-জাতিতত্বের ভিত্তিতে ভারত উপ-মহাদেশ মুক্ত হয়। কিন্তু শোষনের হাত থেকে বাঙ্গালীর মুক্তি আবার হয়ে পরে সুদুর পরাহত। ১৪’শ মাইল দুরের খান-পাঠানদের নির্যাতনের রোষানলে নিপতিত হয় বাঙালীর ভাগ্য। পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর হাতে জিম্মী হয়ে পরে ৫৬ হাজার বর্গ মাইলের প্রায় বৃহত্তর এক জনগোষ্ঠীর মানুষের মুখের ভাষা সহ সামগ্রিক জীবনপঞ্জি। বন্দিদশা থেকে শত বছরের ঘুমন্ত বাঙ্গালীকে স্বাধীনতার স্বপ্ন-সাধে উজ্জীবীত করে তোলেন বাঙালীর হাজার বছরের আরাধ্য পুরুষ, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি এই জাতিকে মুক্ত করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরম প্রত্যয়ে গড়ে তোলেন ধারাবাহিক আনোদলনের অনবদ্য পটভূমি। এ আন্দোলনে শেখ মুজিবের সাথে যোগ হয় কৈশোর উত্তীর্ণ মুক্তি পাগল বাঙালী তরুন শরীয়তপুরের আব্দুর রাজ্জাক।
১৯৪২ সালের ১ আগষ্ট বর্তমান শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলার দক্ষিন ডামুড্যা গ্রামের আলহাজ ঈমাম উদ্দিন বেপারী ও আকফাতুননেছার ঘরে জন্ম নেয়া তাদের কনিষ্ট পুত্র আব্দুর রাজ্জাক। তিনি তার রাজনৈতিক মেধা, প্রজ্ঞা, দুরদৃষ্টি, সাহসিকতা, অভিনব সব নতুন নতুন কৌশল প্রণয়নের মাধ্যমে অন্যান্য সহযোদ্ধাদের পেছনে ফেলে ক্রমেই হয়ে উঠেন শেখ মুজিবের বিশ্বস্ত জনদের মধ্যে অন্যতম। পাকিস্তানিদের আগ্রাসী ছোঁবল থেকে দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার পর্যায়ক্রমিক সৃষ্টিশীল ভূমিকা রাখার কারনে তিনি হয়ে উঠেন বাঙালীর মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম দিকপাল। ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ৬ দফা, ৬৮’র গণ আন্দেলন, ৬৯ এর গণ অভ্যূত্থান, ৭০ এর নির্বাচন সহ জাতির চুড়ান্ত মুক্তির লড়াইয়ে তার নাম উঠে আসে ইতিহাসের একটি উজ্জলতম অধ্যায়ের প্রচ্ছদ বর্ণনায়। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে ইতিহাসের এই বিদগ্ধ রাজনীতিক, নির্লোভ মহান পুরুষ তার নিজ দল ও সরকারের কাছ থেকে চরম অবজ্ঞা, অবহেলা আর তাচ্ছিল্য নিয়ে নিজের স্বাধীন করা দেশ থেকে অনেক দুরে লন্ডনের একটি হাসপাতালে ২০১১ সালের ২৩ ডিসেম্বর বড় অনাদরে মৃত্যু বরণ করেন।
আব্দুর রাজ্জাকের সাড়ে পাঁচ দশকের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণ করলে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় শহীদ চার নেতার পরে আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত অন্য কারো নাম ইতিহাসে এতটা ব্যাপকতা পায়নি। তিনি ৫০ এর দশকের মধ্যম ভাগ থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। ১৯৬০-৬২ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্র সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় জিএস নির্বাচিত হন (এতে শেখ হাসিনার প্রয়াত স্বামী ডঃ ওয়াজেদ আলী মিয়া ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন)। ১৯৬২ সালে বঙ্গবন্ধু আব্দুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ ও সিরাজুল আলম খানের সমন্বয়ে নিউ ক্লিয়াস অব বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা বিএফএল গঠন করে বাঙালীর চুড়ান্ত মুক্তির লক্ষ্যে সংগঠিত হওযার নির্দেশ প্রদান করেন। তিনি ৬৩-৬৫ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৫-৬৬ সালের ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সভাপতি মাজহারুল ইসলাম বাকির সাথে এবং ৬৬-৬৭ সালের কমিটিতে ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর সাথে পর পর দুই বার সাধারন সম্পাদক পদে দায়ীত্ব পালন করেন। ১৯৬৯-৭২ সাল পর্যন্ত আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আব্দুর রাজ্জাক। ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান ছিল আব্দুর রাজ্জাকের। যুদ্ধকালিন মুজিব বহিনীর অন্যতম প্রধান হিসেবে ভারতের দেরহাদুন ও মেঘালয়ে একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৭২ থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন তিনি (বঙ্গবন্ধু ছিলেন সভাপতি)। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু গঠিত বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামীলীগ বা বাকশালের সম্পাদক নির্বাচিত হন আব্দুর রাজ্জাক (বঙ্গবন্ধু ছিলেন চেয়ারম্যান)।
৭৫ ট্রাজেডির পরও ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর মোশতাক-জিয়ার ষড়যন্ত্রে কারাগারে নেয়া হয় পরিশ্রমি এই নেতাকে। দীর্ঘ কারাভোগের পর বঙ্গবন্ধু বিহীন আওয়ামীলীগকে পূনর্গঠনের কাজে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন আব্দুর রাজ্জাক। স্বৈরশাসক জিয়া সরকারের রক্তচক্ষুকে ভয় না পেয়ে তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল চষে বেড়ান মনভাঙ্গা কর্মীদের ও দলকে সংগঠিত করতে। ১৯৭৮ সালে আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত আব্দুল রাজ্জাক, সভাপতি ছিলেন আব্দুল মালেক উকিল।
জিয়া সরকার আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে একের পর এক স্টীমরুলার চালাতে থাকে। দলকে শক্তিশালী করা ও দলীয় নেতৃত্বে গতি ফেরাতে আব্দুর রাজ্জাক একান্ত নিজস্ব চিন্তা থেকে এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন।