আমি মাহেরীন মিস
২১ জুলাই, ২০২৫ দুপুর একটা তেরো,
মনে পড়েনি দুটি সন্তানের কথা
যারা নয়মাস আমার গর্ভে ছিল
কী প্রচন্ড যন্ত্রনা সয়ে ওদের জন্ম।
ভুলে গেছি ওদের বাবার কথাও
আমি কি মা, না মা নামের কলন্ঙ্ক ?
কী প্রচণ্ড গগনবিদারী শব্দ
একেই বুঝি কেয়ামত বলে
ভুলিয়ে দিল আমায়
আমার ভাবনা ছিল যত,
উদয় হলো যেন দানবের মত।
দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন
পুড়ে যাচ্ছে ফুল কলিরা।
কে যেন আমায় বাধা দিল প্রচন্ড
‘যাবেন না যাবেন না’-
সে পাগল ছিল নাকি ?
পোড়া ছোট্ট দেহ মা মা বলে
পড়ছে ঢলে মৃত্যুর কোলে
নিরাপদে নামিয়ে, ছুটছি আবার
আমার যে আছে ফুলের বাগান
ফুলেরা পুড়ছে, পুড়ছে, পুড়ছে!
বারুদের গন্ধ আর বিষাক্ত গ্যাস
পরোয়া করিনি কিছুই
সীতার মত পরীক্ষা দিয়েছি
এ আগুন আগে দেখিনি, তবে পড়িয়েছি,
পাথরে পাথরে ঘষে ওর জন্ম!
তারপর শুনি চিৎকার, আর্তনাদ
জ্বলে গেল, মাগো বাঁচাও বাঁচাও,
বিধাতা স্বর্গ থেকে পাঠিয়েছেন ওদের
মানবতার সেবায়, মৃত্যুর আগ মূহুর্তের বন্ধু
ছুয়ে দিলে মনে হলো, এ যাত্রা বেঁচে যাবো।
আর কিছু মনে নেই
আমায় শীতল পানিতে গোসল করালো
সে যে কি শান্তি, মনে হলো বরফের দেশ
পছন্দের রংয়ের সাদা কাপড় পরিয়ে দিল।
ওদের কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলে গেছি !
একি আমার সন্তানেরা কাঁদছে কেন?
কত যতনে বড় করেছি ওদের
কান্নার আগেই খেলনা এগিয়ে দিয়েছি
ওরা ছিল আমার জীবন
কেঁদোনা তোমরা সইতে পারি না।
সবাই কাঁদছে, প্রলাপ বকছে
শান্তনা দেয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি
ওরা জানেনা আমি কোথায় চলেছি,
আগুনের উৎকট গন্ধ ছাপিয়ে আসছে
আগর আর লোবানের সুগন্ধ।
আমায় বরফের গাড়ীতেই রাখলো
সবাই ছুটে এলো, কান্না শুধু কান্না
কেউ হাত ধরে বলেনি, ঘরে চলো,
তোমার কষ্টের কথা বলো,
হঠাৎ পেলাম আশার আলো।
আমিতো পেরিয়েছি অনেকটা পথ
যা না পাওয়ার তাও পেয়েছি,
ঐ ছোট্ট প্রাণগুলো যে এখনো কুঁড়ি
পাপড়ি মেলবে বলে আশা করে আছে
অজানা পথে যেতে ভয় পায় পাছে !!
সে যে অজানা দেশ,
অচেনা জীবন, বাবা নেই, মা নেই
তাই ওদের ভরসা শুধুআমারউপরেই।
যে ভালবাসা ওরা আমায় দিয়েছে
সেই মমতায় ওদের সাথেই চলেছি।
কেঁদোনা তোমরা, ভেবোনা ভালবাসিনি
কত ভালবাসি বোঝাতে পারিনি।
ফুল কুঁড়ি হারিয়ে কাঁদছো যারা,
জেনে রাখো, আমরা সুখেই রবো
হয়ে আকাশের তারা।
হে মৃত্যুঞ্জয়ী মাহরিন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় তোমায় বলি,
“দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল আলোক, তবে তাই হোক।
মৃত্যু যদি কাছে আনে তোমার অমৃতময় লোক
তবে তাই হোক॥”
(শান্তিনিকেতন, ২৫ জানুয়ারি ১৯৩৭)
লেখকঃ শেলীনা আফরোজা,
নিকুঞ্জ, ২৫ জুলাই, ২০২৫।