ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার গৃহহীন নিঃস্ব নারী সাবিরন আক্তার চার বছর আগে স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে ভাইদের বাড়িতে আশ্রয় নেন। কাপড় সেলাই করে তাকে তার ভাইদের পরিবারে সাহায্য করতে হতো। দেড় বছর আগে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দশটি বিশেষ উদ্যোগের মধ্যে একটি আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় তার নিজের ২ শতাংশ জমিসহ একটি আধা-পাকা বাড়ি পেয়েছিলেন।
নিজ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রায়ণ-২ প্রকল্পের সরাসরি সুবিধাভোগী সাবিরন আক্তার বাসসকে বলেন, চার বছর আগে তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়। এরপর ভাইদের আশ্রয়ে নিজের সামান্য আয় দিয়ে কোনভাবে জীবন যাপন করেছি। আমি যখন নতুন বাড়ি পেলাম, স্বামী ফিরে এলো। আমার জমানো টাকা দিয়ে স্বামীর জন্য একটি অটোরিকশা কিনে দিলাম। তারপর আমি আমার নতুন বাড়িতে সেলাই করা ছাড়াও কাপড়ের একটি ছোট ব্যবসা শুরু করি। এখন আমাদের মাসিক আয় ১৮,০০০ থেকে ২০,০০০ টাকা। এখন আমি খুব খুশি কারণ আমি আমার নতুন বাড়ি পাওয়ারর পরে নতুন করে আমার সংসার শুরু করতে পেরেছি। এখন আমার স্বপ্ন কিছু সেলাই মেশিন কিনে একটি ছোট পোশাক কারখানা তৈরি করার।”
দলিত (জেলে) সম্প্রদায়ের সদস্য মধ্যবয়েসী সুধা রানী মালো, তার পরিবারের ছয় সদস্য নিয়ে ছিলেন আশ্রয়হীন, অনেক কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। মাঝে মাঝে নগরকান্দা উপজেলার কাইচাইল ইউনিয়নের একটি বাড়ির পাশে ছোট একটি জরাজীর্ণ কুঁড়েঘরে থাকতেন তারা। তার স্বামী সুভাষ মালো মাছ ধরে খুব অল্প উপার্জনে তার সংসার চালাতেন এবং তাদের কুঁড়েঘরে থাকার জন্য ভাড়া দিতে হতো। সূধা রাণী তার অনুভুতি এভাবে ব্যক্ত করলেন, “এখন আমরা খুব খুশি, কারণ আমরা আমাদের নিজেদের মাথার উপরে একটি আশ্রয় এবং ছাদ পেয়েছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ”।
রতন শিকদার (৬০) যার নাতনীসহ পাঁচ সদস্যের পরিবার ভাড়া করা একটি ছোট্ট ঘরে থাকতেন, তিনিও আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের আওতায় একটি বাড়ি পেয়েছেন। তাব অভিব্যক্তি এরুপ -“আমাদের নগরকান্দায় ভাড়া বাড়িতে থাকতে হতো। দারিদ্র্যের জন্য আমরা অনেক কষ্ট পেয়েছি । এখন আমরা আমাদের নিজস্ব একটি স্থায়ী আশ্রয় পেয়েছি। আমরা এটা খুব খুশি”।
আরেক আশ্রয়হীন পবিত্র মালোর জীবনের গল্পও অনেকটা একই রকম। তিনিও অন্য গৃহহীনদের মত এই প্রকল্পের অধীনে একটি আধা-পাকা বাড়ি পেয়েছেন।
ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার জানান, পোড়াদিয়া বালিয়া আশয়ণ প্রকল্পটি নগরকান্দা উপজেলার কাচাইল ইউনিয়নে কুমার নদীর তীরে নির্মিত হয়েছে এবং এখানে ১১০টি ঘর বিতরণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, আশয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় জেলায় তিন ধাপে ৪ হাজার ৯৯৪টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে বাড়ি দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। প্রথম পর্যায়ে ২০৩৫ টি পরিবারকে ঘর দেওয়া হয়েছে এবং দ্বিতীয় ধাপে ১৫৭২ টি পরিবারকে জেলায় গৃহ হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, গত ২৬ এপ্রিল তৃতীয় ধাপে, ঈদুল ফিতরের আগে উপহার হিসাবে ৬৯৬ টি বাড়ির চাবি গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারকে হস্তান্তর করা হয়েছে। তৃতীয় ধাপে মোট ১৩৮৭টি পরিবার ঘর পাবে বলে, এজন্য আরও ৬৯১টি ঘর নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
আশ্রয়ণ-২ এর উপ প্রকল্প পরিচালক মো. মাহমুদুল হক আজ বাসসকে বলেন, প্রকল্পটির তৃতীয় ধাপে আরো প্রায় ৩৫,০০০ ঘর হস্তান্তরের জন্য পস্তুত করার কাজ চলমান রয়েছে। তিনি বলেন, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের তৃতীয় ধাপের আওতায় সারাদেশে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মধ্যে আরও ৬৫,৬৭৪টি ঘর বিতরণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকার। এর মধ্যে, প্রধানমন্ত্রী গত রোজার ঈদের আগে ২৬ এপ্রিল ৩২,৯০৪টি বাড়ি হস্তান্তর করেছেন। সারা দেশের ৪৯২টি উপজেলায় এসব ঘর নির্মাণ করা হয়েছে।
মুজিববর্ষে সারাদেশে প্রতিটি ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষকে গৃহায়ণের আওতায় নিয়ে আসার সরকারি অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় তিন ধাপে এ পর্যন্ত ১৫০,২৩৩টি বাড়ি বিতরণ করা হয়েছে।
২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারী, ৬৩,৯৯৯টি গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবার প্রথম ধাপের অধীনে ঘর পেয়েছিল এবং ৫৩,৩৩০টি পরিবার। গত বছরের ২০ জুন আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদের মাথার উপর একটি ছাদ পেয়েছে। প্রকল্পের বিবরণ অনুযায়ী, এ পর্যন্ত প্রকল্পের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ১,১৭,৩২৯টি বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে এবং ২০২১-২০২২ সালের চলতি অর্থবছর পর্যন্ত ১,৮৩,০০৩টি বাড়ি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীন, গৃহহীন, হতদরিদ্র ও উৎপাটিত পরিবারের স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে জমি ও বাড়ির মালিকানা দেয়া হয়। প্রতিটি ইউনিটে দ’ুটি কক্ষ, একটি রান্নাঘর, একটি টয়লেট এবং একটি বারান্দা রয়েছে, যার মূল্য ২৫৯,৫০০ টাকা কর ও ভ্যাট ছাড়াই। ট্যাক্স ও ভ্যাটসহ এর পরিমাণ ৩৩০,০০০ টাকা।
আশ্রয়ণ-২ এর তৃতীয় পর্বে বাড়িগুলোকে আরও টেকসই এবং জলবায়ু সহনশীল করতে সরকার খরচ বাড়িয়েছে এবং নকশায় পরিবর্তন এনেছে। বাড়িগুলিকে আরও টেকসই করতে প্রতিটি বাড়ির জন্য খরচ ১,৯১,০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২,৫৯,৫০০ টাকা করা হয়েছে। সরকার বাড়িগুলিকে আরও টেকসই করার জন্য শক্তিশালী গ্রেট-বিম, লিন্টেল এবং আরসিসি পিলার বিশিষ্ট বাড়িগুলি নির্মাণ করেছে। চলতি অর্থবছর পর্যন্ত বাড়ি নির্মাণে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৯৭২ কোটি ৭ লাখ ৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। খাস জমি ছাড়াও গৃহহীন ও ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের জন্য সরকার ১৬৮ দশমিক ৩২ একর জমি কিনেছে। ইতিমধ্যেই জমি কেনার জন্য ১১৫ দশমিক ৩৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। সরকার প্রকল্পের বাড়ি নির্মাণের জন্য সারাদেশে অবৈধ দখল থেকে ২,৯৬৭ কোটি ৯ লাখ টাকা মূল্যের ৫,৫১২.০৪ একর খাস জমি উদ্ধার করেছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে, ১৯৯৭ থেকে মার্চ, ২০২২ পর্যন্ত মোট ৫,০৭,২৪৪ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে এবং পুনর্বাসিত পরিবারগুলিকে তিন মাসের জন্য ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে। পুনর্বাসিত পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন উৎপাদনশীল এবং আয়বর্ধক কর্মকান্ডে নিয়োজিত করার জন্য ব্যবহারিক এবং প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য ক্ষুদ্রঋণ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা যেমন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, সমবায়, মহিলা ও শিশু অধিদপ্তর, সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে বিতরণ করা হয়। পুনর্বাসিত পরিবারগুলোর জন্য বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে এবং প্রকল্পের জায়গায় নিরাপদ পানির জন্য নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে।
কমিউনিটি সেন্টার, প্রার্থনা ঘর এবং কবরস্থান, পুকুর এবং অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য রাস্তা দিয়ে আবাসন প্রকল্পগুলোকে সহজতর করা হয়েছে।বাসস