আগামী সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে একাধিক নিতে ভোটগ্রহণের কথা ভাবছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সেই সঙ্গে নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র ও ভোট কক্ষে সিসিটিভি স্থাপনের চিন্তা করছে ইসি।
এ ছাড়া আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা সাপেক্ষে সংসদের সাধারণ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার বাড়াতে চায় এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।
সম্প্রতি বিশিষ্টজন, গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপের প্রেক্ষাপটে ইসি এই মতামত প্রকাশ করেছে।
রবিবার ইসির যুগ্ম সচিব (জনসংযোগ) এস এম আসাদুজ্জামান এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সবার সঙ্গে আলোচনা করে সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। গত দুই মাস ধরে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপ থেকে আসা প্রস্তাবের ভিত্তিতে ইসির ভাবনা গণমাধ্যমকে লিখিত আকারে দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, নির্বাচন কমিশন আগামী ১৫ জুন অনুষ্ঠেয় কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিটি কেন্দ্র ও ভোটকক্ষে সিসিটিভি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
নির্বাচন কমিশন বিগত ১৩ মার্চ, ২২ মার্চ, ৬ এপ্রিল ও ১৮ এপ্রিল দেশের শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, নাগরিক সমাজ, প্রিন্ট মিডিয়ার সম্পাদক/সিনিয়র সাংবাদিক এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রধান নির্বাহী/প্রধান বার্তা সম্পাদক/সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে সংলাপ করে।
ওই সংলাপে এসব প্রতিনিধিরা ইসিকে বেশ কিছু পরামর্শ দেন।
নির্বাচন কমিশন স্টেকহোল্ডারদের মতামত ও পরামর্শ গুরুত্বসহ পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করে তাদের মতামত দিয়ে গণমাধ্যমকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে।
এ পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রাখা হবে বলে এতে জানানো হয়।
এ ছাড়া সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী কমিশন যথাযথ করণীয় নির্ধারণ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলেও ইসি উল্লেখ করেছে।
নির্বাচন কমিশনের মতামত
১. অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন-আকাঙ্ক্ষা ও গুরুত্ব নির্বাচন কমিশন সর্বদা অনুধাবন করে থাকে। নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে কমিশন সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাবে। সব রাজনৈতিক দল, বিশেষত প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলকে অচিরেই সংলাপে আহ্বান করা হবে।
২. ভোটকেন্দ্রে ও ভোটাধিকার প্রয়োগে অর্থশক্তি ও পেশিশক্তির প্রভাব প্রতিরোধ করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবার, বিশেষত আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সহায়তা প্রয়োজন হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদেরও এ লক্ষ্যে স্ব-স্ব অবস্থান থেকে অতন্দ্রিত ভূমিকা পালন করতে হবে।
৩. নির্বাচনে অর্থশক্তি ও পেশি শক্তির প্রভাব প্রতিরোধ করতে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সজাগ দৃষ্টি রেখে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, মতৈক্য ও সমঝোতা এহেন সমস্যা নিরসনে প্রভূত ভূমিকা রাখতে পারে।
৪. নির্বাচনে কারচুপির সুযোগ প্রতিরোধ করে অবাধ ও নিরপেক্ষ ফলাফল নিশ্চিতে নির্বাচন কমিশন সম্ভব সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের এ বিষয়ে সজাগ থেকে নজরদারিসহ সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
৫. প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপ্রতুল হলে নির্বাচন একাধিক দিনে কয়েকটি ভাগে সম্পন্ন করা যেতে পারে মর্মে প্রস্তাবনা বিষয়ে কমিশন সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বিষয়টির সম্ভাব্যতা, উপযোগিতা, সুবিধা, অসুবিধা ইত্যাদি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
৬. ভোটের সময় ভোটকেন্দ্রে কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য অনুমোদিত সাংবাদিকদের এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের অবাধ সুযোগ প্রদান নিশ্চিত করতে কমিশন আন্তরিকভাবে চেষ্টা করবে।
৭. স্বচ্ছতার জন্য ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা প্রতিস্থাপন করে ভোটকেন্দ্রের অভ্যন্তরভাগের দৃশ্য বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ সৃষ্টির বিষয়টি কমিশন সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করবে।
৮. ইভিএমের শুদ্ধতা ও অপপ্রয়োগ রোধ নিশ্চিত করতে কমিশন ইতোমধ্যে কয়েকটি সভা করেছে। পরীক্ষা ও পর্যালোচনা অব্যাহত রয়েছে। অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষার নিমিত্তে আগামীতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ বিশিষ্টজনদের অংশগ্রহণে আরো পর্যালোচনা সভার আয়োজন করা হবে। এরপর কমিশন আগামী জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার বা ব্যবহারের পরিধি ও বিস্তৃতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
ইসির তথ্য অনুযায়ী সংলাপে আসা মতামত, পরামর্শ ও প্রস্তাবনাসমূহ
১. নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হতে হবে অর্থাৎ নির্বাচনে বিশেষত প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
২. নির্বাচন অবাধ হতে হবে। ভোটারদের স্বাধীন ভোটাধিকার প্রয়োগে সম্ভাব্য সব প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করে নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগের অনুকূল পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
৩. নির্বাচনে সম্ভাব্য সব কারচুপির সুযোগ প্রতিরোধ করে শুদ্ধ ও নিরপেক্ষ ফলাফল নিশ্চিত করতে হবে।
৪. ভোটকেন্দ্রে ভোটাধিকার প্রয়োগে অর্থশক্তি ও পেশিশক্তির ব্যবহার ও প্রভাব প্রতিরোধ করতে হবে।
৫. রিটার্নিং অফিসার হিসেবে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে বা তাদের পাশাপাশি যতদূর সম্ভব কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা বা বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া সমীচীন হবে।
৬. ভোটের সময় ভোটকেন্দ্রে অনুমোদিত সাংবাদিকদের অবাধ প্রবেশাধিকার দিতে হবে।
৭. ভোটগ্রহণ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের অবাধ সুযোগ দিতে হবে।
৮. ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগ অবাধ, নির্বিঘ্ন, স্বচ্ছ ও দৃশ্যমান করতে সিসি ক্যামেরা প্রতিস্থাপন করে ভোটকেন্দ্রের অভ্যন্তরের দৃশ্য বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ প্রদান করা যেতে পারে।
৯. ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বজায় রেখে সম্ভাব্য সহিংসতা প্রতিরোধ করতে হবে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ বিষয়ে তাদের দায়িত্ব পালনে বাধ্য করতে হবে।
১০. প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনীকে ভোটের সময় নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে।
১১. প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপ্রতুলতা হলে নির্বাচন একাধিক দিনে কয়েকটি ভাগে অনুষ্ঠান করা যেতে পারে।
১২. ইভিএমের শুদ্ধতা ও অপপ্রয়োগ প্রতিরোধ নিশ্চিত করা না গেলে ইভিএমের ব্যবহার পরিহার করে কাগজী ব্যালটের মাধ্যমে ভোট অনুষ্ঠান করতে হবে।
১৩. ইভিএমের শুদ্ধতা ও সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে ইভিএমের ব্যবহার বিস্তৃত করা যেতে পারে।
১৪. নির্বাচন কমিশনকে গৃহীত শপথের প্রতি অনুগত থেকে সৎ, নিরপেক্ষ ও সাহসী হয়ে সংবিধান ও আইন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে হবে। নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে সংবিধান ও আইনে প্রদত্ত ক্ষমতা সততা ও সাহসিকতার সাথে প্রয়োগ করতে হবে।
১৫. নির্বাচন কমিশনকে আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠে দেশবাসীর কাছে আস্থাভাজন হতে হবে।
১৬. নির্বাচন যে অবাধ, নিরপেক্ষ ও কারচুপিমুক্ত হচ্ছে তা দৃশ্যমান হতে হবে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে আগের ছয় মাসের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রাক-নির্বাচন প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই সংলাপের আয়োজন করে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন।