প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (৪আইআর) সংশ্লিষ্ট সরঞ্জামগুলোকে মানবতাকে আঘাত করে বা ক্ষুণ্ণ করে এমন কাজে ব্যবহার না করার বিষয়টি নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সরঞ্জামগুলোকে যেন আমাদের মানবতাকে আঘাত বা ক্ষুণ্ণ করে এমন কাজে নিয়োজিত করা না হয়।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) আয়োজিত ‘নিউ ইকোনমি অ্যান্ড সোসাইটি ইন স্মার্ট বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানের পর প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার মো. নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব যেন সমাজে বিভাজন সৃষ্টি না করে সে বিষয়টিও নিশ্চিত করার ওপর প্রধানমন্ত্রী জোর দিয়েছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে ৪আইআর আমাদের সমাজের মধ্যে আরও বিভাজন তৈরি করবে না। এই উদ্দেশ্যে আমাদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্যকর সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে হবে।
এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার দেশের তরুণদের ৪আইআর ও ভবিষ্যৎ কাজের জন্য তৈরি করতে শুরু করেছে। আমি আত্মবিশ্বাসী যে আমাদের ছেলে-মেয়েরা শুধু ৪আইআরকে শুধু অনুসরণ করবে না, বরং প্রকৃতপক্ষে এর নেতৃত্ব দেবে।
দেশের শিক্ষার্থীরা রোবোটিক্সে যে ধরনের উদ্ভাবনী কাজ করছে, তা দেখে তিনি উৎসাহ বোধ করেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সারাদেশে যে উদ্ভাবন মেলার আয়োজন করে আসছি, সেখানেও তাদের মধ্যে দারুণ উৎসাহ দেখেছি। বাংলাদেশ অবশ্যই ডব্লিউইএফের সঙ্গে অংশীদারিত্বে একটি স্বাধীন ৪আইআর কেন্দ্রকে স্বাগত জানাবে।
সরকার ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে ৪আইআর এর জন্য যথাযথ আইন, নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরির জন্য কাজ করছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অব থিংস, ন্যানোটেকনোলজি ইত্যাদি বিষয়ে পৃথক জাতীয় কর্ম-কৌশল তৈরি করেছি। এ লক্ষ্যে সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি, ন্যানোটেকনোলজি এবং অন্যান্য বিষয়ে বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট স্থাপন করছে।
তাই বাংলাদেশ একটি গ্লোবাল ডিজিটাল কমপ্যাক্ট তৈরির বিষয়ে জাতিসংঘের কাজে আগ্রহী উল্লেখ করে শেখ হাসিনা আরও বলেন, আমরা আশা করি যে এই গ্লোবাল কমপ্যাক্টে ডিজিটাল ও সীমান্ত প্রযুক্তির দায়িত্বশীল ও উৎপাদনশীল ব্যবহারের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য স্পষ্ট নির্দেশনা থাকবে। স্মার্ট গভর্নেন্সের জন্য ভবিষ্যতের রাজনৈতিক নেতাদের বিকাশের জন্য আমরা স্মার্ট লিডারশিপ একাডেমিও চালু করেছি।
সাইবার-আক্রমণ, বিভ্রান্তিকর তথ্য ও অন্যান্য অপকর্মের বিরুদ্ধে সুরক্ষা ব্যবস্থা রাখার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, আমাদের সম্মিলিতভাবে সাইবার-আক্রমণ, বিভ্রান্তমূলক তথ্য ও অন্যান্য অপকর্মের বিরুদ্ধে সুরক্ষা ব্যবস্থা রাখতে হবে।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি পরিস্থিতি ব্লেন্ডেড শিক্ষার অপার সম্ভাবনার বিষয়ে সরকারের চোখ খুলে দিয়েছে। আমরা মহামারির সময়ে দেশব্যাপী ডিজিটাল কাঠামোর সম্পূর্ণ সুবিধা গ্রহণ করেছি। আমরা শিক্ষাব্যবস্থাকে অনলাইনে চালু করেছি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাজ কমবেশি নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে গিয়েছে।
তিনি বলেন, সরকার সারাদেশের শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে দৈনিক লেকচার সেশন সম্প্রচারের ব্যবস্থা করে সংসদ টিভি চ্যানেলকে একটি শিক্ষা চ্যানেলে পরিণত করেছে। এটি নিয়মিত স্কুলে না যাওয়ার ক্ষতি আংশিকভাবে পুষিয়ে দিতে পারে।
শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন, সরকার সব পাঠ্যপুস্তক অনলাইনে আপলোড করে বিনামূল্যে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। এটি শিক্ষার বিষয়বস্তু এবং মডেল ক্লাস লেকচার আপলোড করার জন্য ‘মুক্তপথ’ নামে একটি অ্যাপ চালু করেছে। আমরা শিক্ষকদের অনলাইন শিক্ষার পদ্ধতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য তাদের অভিযোজন করার ব্যবস্থা করেছি।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার মূল্যায়ন পদ্ধতিতে যথাযথ পরিবর্তন আনার জন্য শিক্ষক ও প্রশাসকদের পরামর্শ দিয়েছে। আমি আশা করি যে, এই উদ্যোগগুলি অনেকাংশে শিখন ক্ষতি কমাতে পারে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে গঠনমূলক চিস্তাভাবনা ও সৃজনশীলতার ওপর জোর দিতে সরকার এখন দেশের স্কুল পাঠ্যক্রমকে নতুন করে সাজিয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা তাদের মুখস্তবিদ্যা রপ্ত করার পরিবর্তে নিজেরাই যেন চিন্তা করতে এবং কাজ করতে পারে সে বিষয়ে উৎসাহিত করছি। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সামাজিক এবং বিশ্লেষণাত্মক দক্ষতা দিয়ে গড়ে তোলার আশা করি, যেন তাদের বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত করতে পারি। সরকার প্রি-স্কুলিংয়ের পাশাপাশি স্নাতকোত্তর গবেষণা ও উন্নয়নকেও গুরুত্ব দিচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, গত বছর নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ মহাসচিবের ট্রান্সফর্মিং এডুকেশন সামিটে বাংলাদেশ কিছু সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আমাদের সরকার মানসম্পন্ন, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং রূপান্তরমূলক শিক্ষা অর্জনের জন্য সেই দূরদর্শী প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) সর্বশেষ সভাপতিত্বের সময় বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁকিকে স্থিতিস্থাপকতা ও সমৃদ্ধির মধ্যে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়। এটি অর্জনের জন্য, আমরা প্রাথমিকভাবে চারটি মূল নথি অনুসরণ করব।
প্রথমত, গ্রিন-হাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে নির্দিষ্ট সময়-সীমাবদ্ধ প্রতিশ্রুতিসহ জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি) ইউএনএফসিসিতে জমা দেয়া।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার সভাপতিত্বে একটি ডেল্টা গভর্নিং কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে সরকার ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করেছে। আমরা বর্তমানে বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে আমাদের রাজধানী ঢাকার চারপাশের পাঁচটি নদী পুনরুদ্ধারের মতো উচ্চ-প্রভাব বিস্তারকারী মেগা-প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করছি।
তিনি আরও বলেন, এই উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনাগুলোর কিছু বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বেসরকারি খাতের বিপুল পরিমাণে অর্থায়ন জোগাড় করতে হবে। আমি ডব্লিউএফকে আমাদের পক্ষে প্রচারে ভূমিকা পালন করতে অনুরোধ করব। আমি আপনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বেসরকারি খাতকে আশ্বস্ত করতে পারি যে বাংলাদেশে বিনিয়োগের কাঙ্ক্ষিত প্রভাব পড়বে কারণ আমরা বারবার প্রমাণ করেছি।
সূত্র: বাসস