আম্পায়ারের ওয়াইড সিগন্যাল দেখেই বুনো উল্লাসে ছুটলেন রিশাদ হোসেন। তাকে ধরতে ডাগআউট থেকে ছুটে এলেন বাকিরা। ম্যাচ জেতানো রানটা ওয়াইড থেকে এলেও খানিক আগে দুলতে থাকা ম্যাচের গতিপথ ছক্কায় ঠিক করে দিয়েছেন রিশাদই। বারবার রঙ বদলানো বিপিএলের ফাইনাল জিতে টানা দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ফরচুন বরিশাল।
শুক্রবার মিরপুর শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে চিটাগাং কিংসকে ৩ উইকেটে হারিয়েছে বরিশাল। চিটাগাংয়ের করা ১৯৪ রানের পুঁজি ৩ বল আগে পেরিয়ে জিতেছে তারা। বিপিএলের ফাইনালে এটাই রেকর্ড রান তাড়ার জয়। ২০২৩ সালে সিলেট স্ট্রাইকার্সের দেওয়া ১৭৫ রানের পুঁজি পেরিয়ে আগের রেকর্ড ছিলো কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের।
১১তম বিপিএল জুড়ে কত কিছুই না ঘটে গেল। তবে বাইরের সব ঘটনাকে একপাশে রেখে বাইশ গজের লড়াই ছিল জমজমাট। ৪০ দিনের ৪৬ ম্যাচের লড়াইয়ে কি ছিল না? রানের বন্যায় চার-ছক্কার ফুল ঝুড়ি, আট সেঞ্চুরি, ব্যাটারদের উইকেটে বোলার রেকর্ড, লোকাল ক্রিকেটারদের জ্বলে ওঠা থেকে গ্যালারি জুড়ে দর্শকদের উৎসব। বিতর্ক বাদ দিয়ে মাঠের ক্রিকেট হিসাব করলে ভালো মার্কসই পাবে বিপিএল।
ফাইনাল জুড়েও ছিল যথেষ্ট উত্তেজনার ছাপ। পুরো টুর্নামেন্টের ছন্দ ধরে রাখা বরিশালের প্রতিপক্ষ বন্দরনগরীর চিটাগং কিংস। ধারেভারে কিংসের চেয়ে এগিয়ে বরিশাল। দলে আছে বাঘা বাঘা নাম। আছে মাঠভর্তী দর্শকদের সাপোর্ট। তাই ফাইনালে সবার বাজি ছিল বরিশালকে নিয়েই। কিন্তু আগে ব্যাটিং করে সেই বাজির দান কিছুটা উল্টে দেওয়ার আভাস দেয় চিটাগং কিংস।
রানের উইকেটে আগে ব্যাট করতে নেমে প্রথম উইকেটেই বরিশাল ভক্তদের হৃদয়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিলেন চিটাগংয়ের দুই ওপেনার খাজা নাফে ও ইমন। প্রথম ৩ ওভারে ২৩ রান নেওয়া চিটাগং কিংসের রান রেট পরের ওভারে দশে নিয়ে গেলেন পারভেজ হোসেন। বাঁহাতি স্পিনার তানভির হোসেনের বলে এক চার ও দুই ছক্কায় নিলেন ১৮ রান।
মেয়ার্সের আগের ওভারে পরপর দুই চার মেরে ডালা মেলেন ইমন। পরের ওভারে তানভিরের বলে সুইপার কাভার দিয়ে মারেন চার। পঞ্চম বলে স্ট্রাইক ফিরে পেয়ে স্লগ সুইপে ৯৩ মিটার দীর্ঘ ছক্কা মারেন ডিপ মিডউইকেট দিয়ে। পরের বলে লং অফ দিয়ে মারেন আরেকটি। এই দুই ব্যাটারের ব্যাটে ১০ ওভারে কোনো উইকেট না হারিয়ে ৯৩ রান তোলে চিটাগং।
এরপর ৩০ বলে ফিফটি পূরণ করেন ইমন। বাঁহাতি এই ব্যাটারের পর হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন নাফে। অবশ্য ফিফটি পূরণের পর বেশিক্ষণ টেকেননি এই ব্যাটার। দলীয় ১২১ রানের মাথায় বরিশাল পেসার এবাদত হোসেন বলে কাট করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে থাকা মুশফিকুর রহিমের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন। সাজঘরে ফেরার আগে খেলেন ৪৪ বলে ৬৬ রানের কার্যকরী ইনিংস।
নাফের বিদায়ের পরও চিটাগংয়ের রানের চাকা থেমে থাকেনি। গ্রাহাম ক্লার্ককে সঙ্গী করে ঝড়ো ব্যাটিং অব্যাহত রাখেন ইমন। দলীয় ১৯১ রানের মাথায় রানআউট হয়ে ফেরেন ক্লার্ক। ২৩ বলে ৪৪ রান করেন ডাহাতি এই ব্যাটার। শেষমেশ চিটাগং থামে ১৯৪ রানে।
প্রথম শিরোপা জয়ের স্বাদ পেতে চট্টগ্রামের ব্যাটাররা নিজেদের দায়িত্ব সারেন ভালোভাবে। কিন্তু বোলাররা আস্থার মান হারান শুরুতেই। টানা দ্বিতীয় ফাইনাল খেলতে নামা বরিশাল বড় রানের চাপ সামলে শুরু থেকে ছিল নির্ভার। তাওহিদকে নিয়ে প্রথম ওভার থেকেই চড়াও হন তামিম। সিঙ্গেল দিয়ে রানের খাতা খোলা তামিম প্রথম ওভারে হাঁকান তিন বাউন্ডারি। পরের ওভারে আরাফাত সানির সামনে হাত খুলতে না পারলেও তৃতীয় ওভারে শরিফুলের বল বাউন্ডারিতে পাঠান আরও তিনবার। ছুটতে থাকা তামিম ব্যক্তিগত পঞ্চাশ ছুঁতে সময় নেন স্রেফ ২৪ বল। দ্বিতীয় স্পেলে বোলিং করতে আসা সানির বল ছক্কায় উড়িয়ে বরিশাল অধিনায়ক স্পর্শ করেন ব্যক্তিগত পঞ্চাশ।
অধিনায়কের সঙ্গে থাকা তাওহিদ খেলেছেন রয়ে সয়ে। এক প্রান্তে ঝড় তুলেছেন তামিম, অন্য প্রান্তে তাওহিদ দিচ্ছিলেন দারুণ সঙ্গ। দুই ওপেনারে চড়ে জয়ের গল্প অনেকটাই লিখে ফেলে বরিশাল। ২৯ বলে ৫৪ রান করে থামেন তামিম। তাওহিদও ফিরে যান ৩২রান করে। পরের পথটুকু বাকিদের নিয়ে পাড়ি দেন কাইল মায়ার্স। চারে নেমে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ এনে দিয়ে মাঠ ছাড়েন মায়ার্স। নিজে খেলেন ২৮ বলে ৪৬ রানের দারুণ ইনিংস। সঙ্গে রিশাদের দারুণ ফিনিশিংয়ে বরিশাল হাসে দ্বিতীয় শিরোপার হাসি।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
চিটাগং কিংস: ২০ ওভারে ১৯৪/৩ (নাফে ৬৬, পারভেজ ৭৮*, ক্লার্ক ৪৪, শামীম ২*, তালাত ০*; মেয়ার্স ৪-০-৩৫-০, আলি ৪-০-২১-১, তানভির ২-০-৪০-০, ইবাদত ৪-০-৩৫-১, নাবি ৪-০-৩৪-০, রিশাদ ২-০-৩৪-০)।
ফরচুন বরিশাল: ১৯.২ ওভারে ১৯৫/৭(তামিম ৫৪, হৃদয় ৩২, মালান ১, মেয়ার্স ৪৬, মুশফিক ১৬, মাহমুদউল্লাহ ৭, নাবি ৪, রিশাদ ১৮*, তানভির ০*; ফার্নান্দো ৪-০-৪২-১, সানি ২-০-১৯-০, শরিফুল ৪-০-৩৪-৪, খালেদ ৪-০-২৯-০, তালাত ৩.৩-০-৪৪-০, নাঈম ২-০-১৮-২)।
ফল: ফরচুন বরিশাল ৩ উইকেটে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: তামিম ইকবাল।
ম্যান অব দা টুর্নামেন্ট: মেহেদী হাসান মিরাজ।