বাসস:
একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে প্রতিবেশী ভারত সরাসরি মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়ায় এবং এর ১৩ দিন পর ঢাকা স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্ত রাজধানী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর আগে নয় মাসের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী প্রায় প্রতিদিনই পাকিস্তানি সৈন্যদের মনোবল ভেঙে দিয়েছিল।
বর্তমানে প্রায় ভুলতে বসা তিন দিনব্যাপী এক ভয়াবহ যুদ্ধকে সামরিক ইতিহাসবিদ ও কৌশলবিদরা চূড়ান্ত বিজয়ের সূচনা হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ’৭১ এর ২০-২২ নভেম্বর এই যুদ্ধে উভয় পক্ষ তাদের ট্যাংক এবং বিমান শক্তি ব্যবহার করে। ইতিহাসে এই লড়াই ‘গরিবপুর যুদ্ধ’ হিসেবে লিপিবদ্ধ আছে।
এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পাকিস্তানের এম-২৪ শ্যাফে ট্যাংক ধ্বংস করতে ভারত রাশিয়ার তৈরি পিটি-৭৬ ট্যাংক ব্যবহার করে এবং ভারতীয় বিমানবাহিনী (আইএএফ) জিনাট যুদ্ধবিমান পাকিস্তানের স্যাবর এফ-৮৬ যুদ্ধবিমানের হামলা মোকাবিলা করে। পাকিস্তানি পক্ষ সৈন্য ও সরঞ্জাম উভয় দিক থেকে শোচনীয় পরিণতির শিকার হয়।
বেশ কয়েকজন সামরিক বিশেষজ্ঞ ‘গরিবপুর যুদ্ধকে’ সবচেয়ে বড় ট্যাংক যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে জলাভূমি এলাকার আঙুল আকৃতির জঙ্গলাকীর্ণ একটি গ্রামে কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্ত বাংলাদেশি মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামান, বীর বিক্রম বাসস’কে জানান, ‘এই যুদ্ধের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।
তিনি আরও বলেন, তবে, উভয় পক্ষ তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে লড়াই করে এবং বিপুলসংখ্যক যুদ্ধ সংক্রান্ত পাঠ রেখে যায়।
ভারতের বয়রা বরাবর বাংলাদেশের ৬ কিলোমিটার অভ্যন্তরে অবস্থিত গরিবপুরের অবস্থান ভারত থেকে চৌগাছা হয়ে যশোর পর্যন্ত মহাসড়কের উভয় পাশে। এই জন্য গরিবপুরকে উভয় দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সড়ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
পাকিস্তানি সামরিক বিশেষজ্ঞদের তথ্য অনুযায়ী তাদের হাই কমান্ডের ধারণা ছিল, এই জলাভূমি এলাকা ‘ট্যাংকের অগম্য’ এবং তারা ভারতীয় ট্যাংকের উপস্থিতি টের পেয়ে হতবাক হয়ে যায়। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা হামলা ও বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে শুরু থেকেই সেখানে পাকিস্তানিদের অব্যাহতভাবে হয়রানির মধ্যে রাখে।
আত্মসমর্পণের প্রত্যক্ষদর্শী পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার গ্রন্থে লিখেছেন, ‘শত্রু বাহিনী (মিত্র বাহিনী) ১৩ নভেম্বর বয়রার (যশোর সেক্টর) কাছে সীমান্ত অতিক্রম করে। তারা সেখানে সাত দিন ধরে লুকিয়ে থাকে। এ সময় ভারতীয়রা পুরো দু’টি সম্পূর্ণ ব্যাটালিয়ন গঠন করে। ১৯ নভেম্বরের দিকে আমরা তাদের উপস্থিতির বিষয়টি জানতে পারি।’
সালিক লিখেছেন, ‘শত্রু বাহিনী (মিত্র বাহিনী) ২১ নভেম্বর সন্ধ্যা ছয়টায় হামলা চালায়। প্রাথমিকভাবে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে তারা (পাকিস্তানি বাহিনী) ভালোই করছিল। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী একটি জঙ্গলে শত্রুপক্ষের অবস্থান লক্ষ্য করে অগ্রসর হলে শত্রু পক্ষ গোপন অবস্থান থেকে ট্যাংকের গোলা বর্ষণ শুরু করে। এটি ছিল আমাদের জন্য একেবারে আকস্মিক। কারণ, আমরা সব সময় এই এলাকাকে ‘ট্যাঙ্কমুক্ত’ হিসেব বিবেচনা করেছি।’
তিনি লিখেছেন, সীমান্ত অতিক্রম করা ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী দ্রুত যুদ্ধে যোগ দেয়। সেখানে পাকিস্তানি সৈন্যরা পিএএফ যুদ্ধবিমানের সহায়তা চায় এবং এর পরপরই ভারতের যুদ্ধবিমানকে মোকাবিলায় পাকিস্তানের তিনটি স্যাবর যুদ্ধবিমানকে আকাশে চক্কর দিতে দেখা যায়।
‘আক্রমণ তখন প্রত্যাহার করা হয়’, সালিক বলেন।
ভারতীয় সামরিক বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন লেখা থেকে দেখা যায়, ঘটনাচক্রে একটি খন্ডযুদ্ধের ফলে মুক্তিবাহিনীর একটি টহল দলকে এই এলাকায় পাকিস্তানিদের একটি নিরীক্ষণ গ্রুপ শনাক্ত করায় মিত্রবাহিনী এখানে অতর্কিত যুদ্ধের সুযোগ হারিয়ে ফেলে।
তবে কতিপয় সামরিক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সে মুহূর্তে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ভারতীয় ট্যাংকের উপস্থিতি সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকলেও তাদের যুদ্ধের নথিপত্র থেকে দেখা যায় ভারতীয় সেনা এবং মুক্তিবাহিনীকে গরীবপুরে শনাক্তকরণের পর অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকাতে পাকিস্তানের ১০৭ ব্রিগেড দুটি টাস্ক ফোর্স গঠন করে।
এ যুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তানিদের গোলার আঘাতে শহীদ হন ভারতীয় ৪৫ ক্যাভালরির ‘সি’ স্কোয়াড্রনের কমান্ডার মেজর ডি এস নারাং। ফলে পুরো যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব এসে পড়ে ক্যাপ্টেন বলরাম সিং মেহতার ওপর।
বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার বলরাম মেহতা ওই সময়ে ভারতীয় সাঁজোয়াবহর কোরের একজন ক্যাপ্টেন ছিলেন।
সম্প্রতি বাসস’র সাথে আলাপকালে তিনি এ যুদ্ধকে ‘দৃষ্টান্তমূলক’ অভিহিত করেন। তিনি আরও বলেন, এটা তখন প্রায় নিশ্চিত ছিল যে পাকিস্তানের সাথে ভারতের সরাসরি যুদ্ধ আসন্ন। তার প্রেক্ষাপটে ভারতীয় বাহিনীর পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে হামলা চালাতে কিছু অ্যাসল্ট লঞ্চিং প্যাডের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।
মেহতা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘গরিবপুর ছিল গুরুত্বপূর্ণ লঞ্চ প্যাডগুলোর মধ্যে অন্যতম কারণ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের যে কোন স্থানের তুলনায় যশোর ছিল ভারতীয় বাহিনীর সবচেয়ে কাছের সুবিধাজনক স্থান।’ এ সময় তিনি যশোরের কৌশলগত গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেন।
ইমামুজ্জামান মেহতার সঙ্গে যোগ করে বলেন, নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে প্রাথমিক অভিযান পরিকল্পনার আওতায় মিত্র বাহিনী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে চৌগাছার কাছাকাছি ওই এলাকা যা বৃহত্তর যশোর এলাকায় পরবর্তী অপারেশনের জন্য লঞ্চিং প্যাড হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর যুদ্ধকালীন দলিলপত্র থেকে দেখা যায় যে গরিবপুর এলাকাকে একটি যুদ্ধ লঞ্চিং প্যাড হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। বড় ধরনের যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানিরা এলাকাটিকে একেবারে অবহেলা করবে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা তা মনে করার পর এটি লঞ্চিং প্যাড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
স্থানীয়রা তখনকার স্মৃতিচারণ করে বলেন, মুক্তিবাহিনীর সদস্য আব্দুস সাত্তার শত্রুর চোখ ফাঁকি দিয়ে ভারতীয় ট্যাংক বহরকে গরিবপুরে নির্ধারিত স্থানে নিয়ে যান। এ সময় গ্রামবাসীর সহযোগিতায় সহকর্মী গেরিলারা কর্দমাক্ত পথে গাছ ফেলে ট্যাঙ্ক যাওয়ার পথ তৈরি করে।
ভারতীয় পক্ষ গরিবপুরে ২১ নভেম্বর পাকিস্তানের ১৪টি শাফি ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে আর ভারত হারায় মাত্র দু’টি। এদিকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সঙ্গে সংঘটিত প্রথম বিমান যুদ্ধে ভারতীয় বিমানবাহিনী জিনাট যুদ্ধবিমানের সাহায্যে পাকিস্তানের দু’টি এফ-৮৬ স্যাবর যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে এবং আরেকটি বিমান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
মেহতা বলেন, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পরপরই তিনি তার ক্রুদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে এক দিন তিনি এ যুদ্ধে তাদের বীরত্ব ত্যাগের বর্ণনা কোন বইয়ে তুলে ধরবেন। অবশেষে তিনি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে রচনা করেছেন ‘দি বার্নিং শ্যাফেস’।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্বয়ং এই যুদ্ধের সফলতা ও গুরুত্ব পার্লামেন্টে তুলে ধরেন। পাকিস্তানের মেজর সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, তাদের শীর্ষ কমান্ডার জেনারেল এএকে নিয়াজি মনে করেন যে এই সম্মুখ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ‘তার সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়েছে।’
যুদ্ধে পাকিস্তানের নেতৃত্বদানকারী ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান পরে বলেন, ‘গরিবপুরের ওপর আক্রমণ ছিল এ যুদ্ধে পাকিস্তানের চালানো সবচেয়ে তীব্র হামলার ঘটনা। তবে, এই হামলার চূড়ান্ত পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী একেবারে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।’
এ যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর ২৮ জন নিহত ও ৪২ জন আহত হয়। এদের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর সদস্যও রয়েছেন। সেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক সদস্য হতাহত হয়। এ সংখ্যা প্রায় ৩০০ হবে বলে ধারণা করা হয়। এদের মধ্যে তিন কর্মকর্তাও ছিলেন।
এরপর পাকিস্তানি পক্ষ এই অঞ্চলে কার্যত তাদের সৈন্যবাহিনী গুটিয়ে নেয় এবং আন্তর্জাতিক সীমানা বরাবর এই এলাকা চূড়ান্ত বিজয়ের আগ পর্যন্ত মিত্র বাহিনীর হাতে থাকে।