সমুদ্র শান্ত থাকার ফলে চ্যানেল পেরিয়ে যুক্তরাজ্যে আসা অভিবাসীর সংখ্যা বাড়ছে৷ গত মঙ্গলবার ১২০ জন অভিবাসী চ্যানেল পেরিয়ে এসেছেন৷ ৬০০ জন ব্যক্তি ছোট নৌকায় চেপে সপ্তাহান্তে চ্যানেল পেরিয়ে যুক্তরাজ্যে এসেছেন৷
বিবিসির সাংবাদিক সিমন জোনস মঙ্গলবার সকালে ডোভার বন্দরের কাছে ছিলেন৷ তিনি জানান, ১২০ জন অভিবাসী সেই সময় চ্যানেল পেরিয়ে যুক্তরাজ্যে পৌঁছেছিলেন৷ উদ্ধার হওয়া অভিবাসীদের ডানজিনেসে নিয়ে যাওয়া হয়৷ চ্যানেল পেরিয়ে এতজন অভিবাসীর আসাটা এমন কিছু আশ্চর্যজনক ঘটনা নয়৷ কারণ আবহাওয়া অত্যন্ত অনুকূল৷ ডোভারের লাইফবোট বুধবারও উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে৷
তবে এই সাংবাদিক জানান, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, উপকূলরক্ষী বাহিনী, সীমান্তরক্ষী এবং লাইফবোট পরিষেবা যারা দেন, তাদের চাপ বাড়ছে৷
২০২২ সালে চ্যানেল পেরিয়েছেন আট হাজারের বেশি
বিবিসি রেডিও মঙ্গলবার অভিবাসী এবং শরণার্থীদের বিষয়ে বিতর্ক সভার আয়োজন করেছিল৷ সেই আলোচনায় উঠে আসে ৬০০ জনেরও বেশি অভিবাসী সপ্তাহান্তে চ্যানেল পেরিয়েছেন৷ চলতি বছরের শুরু থেকে মে মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত চ্যানেল পেরিয়ে আসা অভিবাসীদের সংখ্যাটা আট হাজার ৩০০-র বেশি৷ যুক্তরাজ্য সরকারের মত, ৯ মে থেকে ১৫-র মধ্যে ২৫টি ছোট নৌকায় চেপে ৬০৭ জন অভিবাসী প্রবেশ করেছেন৷ সিমন বলেন, কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে নৌকার আয়তন যেমন রোজ বাড়ছে, বাড়ছে অভিবাসীদের আগমনও৷
কেন্ট রিফিউজি অ্যাকশন নেটওয়ার্কের (কেআরএএন) গণমাধ্যম প্রধান এবং মুখপাত্র ব্রিজেট চ্যাপম্যান অভিবাসন সংক্রান্ত ওই বিতর্কে অংশ নিয়েছিলেন৷ তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৯৮ শতাংশ অভিবাসী আশ্রয়ের আবেদনের জন্য আসছেন৷ তার কথায়, ‘‘আমাদের নির্দিষ্ট পদক্ষেপ করতে হবে এবংউন্নততর কোনো বিকল্পের কথা ভাবতে হবে৷ এতে রাতারাতি পাচারকারীদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে৷’’
‘নিরাপদ এবং আইনি পথ’
চ্যাপম্যান বলেন, নিরাপদ এবং আইনি পথে আশ্রয়ের আবেদন করা প্রয়োজন৷ যুক্তরাজ্য সরকারের পরিসংখ্যান অনুসারে, চ্যানেল পেরিয়ে আসার পরে যারা আশ্রয় আবেদন করেছিলেন, তাদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি ব্যক্তির ক্ষেত্রে তা মঞ্জুর করা হয়েছে৷ যুক্তরাজ্যের জাতীয় পরিসংখ্যান কার্যালয়ের ২০২১ সালের ৩ মার্চের হিসাব অনুযায়ী ‘‘আশ্রয়, মানবিক সুরক্ষা এবং পুনর্বাসনের মাধ্যমে ১৪ হাজার ৭৩৪ জনকে সুরক্ষা দেয়া হয়েছে৷ এদের মধ্যে ৮১ শতাংশ শরণার্থী মর্যাদা পেয়েছেন, ছয় শতাংশকে মানবিক সুরক্ষা দেয়া হয়েছে, ১১ শতাংশকে পুনর্বাসন প্রকল্পের মাধ্যমে শরণার্থী মর্যাদা দেয়া হয়েছে৷
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী শরণার্থীদের সন্তানদের পারিবারিক পুনর্মিলন ভিসার মাধ্যমে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেশি৷
আশ্রয়ের আবেদন
২০২১ সালে আশ্রয়ের জন্য আবেদনকারীদের সংখ্যা বেড়েছে৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, ৪৮ হাজার ৫৪০টি আবেদন জমা পড়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৬৩ শতাংশ বেশি৷ যারা চ্যানেল পাড়ি দিচ্ছেন তাদের অনেকেই ইরান থেকে এসেছেন৷ ২০২১ সালে ইরান থেকে সবথেকে বেশি আশ্রয় আবেদন (নয় হাজার ৮০০ জন) জমা পড়েছিল৷
ছোট নৌকায় চেপে চ্যানেল পার হওয়ার চেষ্টা সবচেয়ে বেশি করে আফগান, সিরীয়, ইরিত্রিয়ান এবং ইরাকিরা৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, ২১ ডিসেম্বর এই দেশ থেকে আসা আশ্রয়প্রার্থীদের প্রাথমিক পর্যায়ের আবেদন মঞ্জুরের হার অনেকটাই বেড়েছে৷ ইরানিদের ক্ষেত্রে বেড়েছে ৮৯ শতাংশ, ইরিত্রিয়ানদের ক্ষেত্রে ৯৭ শতাংশ, সিরীয়দের ক্ষেত্রে ৯৯ শতাংশ, ইরাকিদের ক্ষেত্রে ৪৭ শতাংশ৷ এ ছাড়া আলবেনিয়া থেকে আসা আশ্রয়প্রার্থীদের ক্ষেত্রে এটি ৪৬ শতাংশ, সুদান থেকে আসা অভিবাসীদের ক্ষেত্রে ৯৬ শতাংশ, আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে তা ৮১ শতাংশ৷
আশ্রয় আবেদনকারীদের ৪৬ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ২৯-এর মধ্যে৷ পরের ধাপে রয়েছেন, ৩০ থেকে ৪৯ বছর বয়সিরা৷ ১১ শতাংশ আশ্রয় আবেদনকারী পুরুষের বয়স ১৮ বছরের কম৷ নারীদের ক্ষেত্রে ৩০ থেকে ৪৯ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি আশ্রয় আবেদন করেছেন৷ ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী আশ্রয় আবেদনকারী নারী ছয় শতাংশ৷
বিলাসবহুল ব্যবস্থা থেকে অনেক দূরে
এই মুহূর্তে চ্যানেল পেরিয়ে যারা আসছেন, তাদের অনেককে প্রাথমিক পর্যায়ে কেন্টের ম্যানস্টনে একটি পুরাতন সামরিক ব্যারাকে নিয়ে যাওয়া হয়৷ পরে তাদের আবাসন কেন্দ্র বা সারা দেশে থাকা ছোট ছোট হোটেলে পাঠানো হয়৷অভিবাসী এবং আশ্রয়প্রার্থীদের দামি হোটেলে পাঠানো হচ্ছে, বিনামূল্যে ‘বিলাসবহুল আবাসন’ দেওয়া হচ্ছে বলে ক্ষোভপ্রকাশ করেছেন ব্রিটেনের অনেক বাসিন্দা৷ ব্রিটিশ রেড ক্রস এবং শরণার্থী কাউন্সিলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনভার সলোমন বলেন, ‘‘বাস্তব একেবারেই আলাদা৷’’
রেডিও-র বিতর্কে সলোমন জানান, ‘‘স্কারব্রোর একটি হোটেলে অভিবাসীদের রাখা হচ্ছিল৷এটি একেবারে সাদামাটা, অবস্থা মোটেও ভাল না৷ আপনি বা আপনার পরিবার কয়েকদিন সেখানে থাকলে সে জায়গা ছাড়তে মরিয়া হয়ে উঠবেন৷’’
অতিরিক্ত সামরিক ব্যারাককে কাজে লাগানো?
সংবাদসংস্থা এএফপি জানিয়েছে, ইংল্যান্ডের উত্তরে লিন্টন-অন-ওউসের ইয়র্কশায়ার গ্রামের কিছু বাসিন্দা সেখানকার পুরাতন সামরিক ব্যারাকে দেড় হাজার পুরুষ আশ্রয়প্রার্থীকে রাখার জন্য যুক্তরাজ্য সরকারের পরিকল্পনার বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভপ্রকাশ করেছেন৷
যুক্তরাজ্য সরকার আশ্রয়প্রার্থীদের হোটেলে থাকার জন্য প্রতিদিন প্রায় ৫.৫ মিলিয়ন ইউরো ব্যয় করেছে বলে জানা গিয়েছে৷ পুরাতন ব্যারাকে আশ্রয়প্রার্থীদের থাকতে দিলে খরচ কমবে বলে মনে করছে কর্তৃপক্ষ৷ এএফপিকে এই গ্রামের বাসিন্দা ওলগা ম্যাথিয়াস বলেন, ‘‘মাত্র ৭০০ জনের একটি গ্রামে দেড় হাজার আশ্রয়প্রার্থীকে আবাসন দেওয়া মানে জনসংখ্যার অনুপাতের বিষয়টি একবারও ভেবে দেখা হয়নি৷গ্রামের পরিকাঠামো ভেঙে পড়েছে৷ গ্রামে কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই৷ সবথেকে কাছের শহর ইয়র্ক৷ কিন্তু ইয়র্কে শুধুমাত্র যাওয়ার ভাড়াই আশ্রয়প্রার্থীর দৈনিক ভাতার চেয়ে বেশি৷’’
আশ্রয়প্রার্থীদের এই গ্রামে রাখা হলে বাড়ির দামে প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন স্থানীয়রা৷ স্থানীয় একটি দল শরণার্থীদের সাহায্য করে৷সেই দলের তরফে নিকোলা ডেভিড এএফপিকে জানিয়েছেন, ‘‘কেউ এই বিষয়টি সমর্থন করছে না৷ স্থানীয় কিংবা অতি ডানপন্থি কোনো ব্যক্তি কিংবা শরণার্থীদের সাহায্যকারী সংস্থা–কেউ সমর্থন করছে না৷শুধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এটা করছে৷ লিন্টন-অন-ওউসে এর প্রভাব পড়বে৷’’
অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলি জানিয়েছে আবাসনগুলিতে অতিরিক্ত ভিড়৷ এর ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে৷ যুক্তরাজ্যে আসার আগেই যারা সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাদের জন্য এমন ব্যবস্থা করার তীব্র সমালোচনা করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও৷
ফরাসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সপ্তাহান্তে ফ্রান্সের উপকূল থেকে অন্তত ১১৩ জনকে চ্যানেল পার হওয়ায় বাধা দেয়া হয়েছে৷ চ্যানেল এবং নর্থ সি-র এলাকার ক্ষেত্রে মেরিটাইম প্রিফেক্ট বলেছে, রবিবার থেকে সোমবার রাতের মধ্যে বেশ কয়েকটি ছোট নৌকাকে তারা সাহায্য করেছে৷ নৌকাগুলি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ছিল৷
৩৮ জন অভিবাসীর একটি দলকে বার্ক-সুর-মেরে নিয়ে যাওয়া হয় মঙ্গলবার৷সাতটি নৌকা উপকূলের কাছাকাছি থাকায় তাদের বুলনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে ২৩ জন আশ্রয়প্রার্থী-সহ একটি পৃথক অভিবাসী নৌকাও বুলনে ফেরানো হয়৷
ফরাসি কর্তৃপক্ষ সতর্ক করেছে, এই মুহূর্তে চ্যানেলের চারপাশের আবহাওয়া শান্ত৷ তবে দ্রুত আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়৷এটি বিশ্বের ব্যস্ততম শিপিং জোনগুলির একটি৷ এখানে বছরে কমপক্ষে ১২০ দিন প্রবল বেগে ঝোড়ো হাওয়া বইতে থাকে, যা সমুদ্রপথকে আরো বিপজ্জনক করে তোলে৷