ঝিনাইদহ সড়ক ও জনপথ বিভাগের আড়াই’শ কোটি টাকার কাজে চরম অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে কয়েকটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। সওজের কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশে অতি নিম্নমানের কাজ করে যাচ্ছে ঠিকাদাররা। পুরানো রাস্তার পাথর ভেঙ্গে নতুন রাস্তায় ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে ঝিনাইদহ সওজ ঠিকাদারদের চিঠি দিয়েও কাজের মান পরিবর্তন না হওয়ায় মৌখিকভাবে দুইটি কাজ বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু ঠিকাদাররা তাদের নিজ ক্ষমতাবলে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
সড়ক বিভাগে তথ্য নিয়ে জানা গেছে, ঝিনাইদহ সড়ক বিভাগের অধীন ৮ টি রাস্তা ও ৮ টি ব্রীজে প্রায় আড়াই’শ কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে। কাজগুলো হচ্ছে ঝিনাইদহের মহেশপুর, খালিশপুর, দত্তনগর, জিন্নানগর হয়ে যাদবপুর যাওয়ার সড়কটি ২০১৮ সালের ২৮ নভেম্বর কাজ শুরু হয়। এ কাজে বরাদ্দ রয়েছে ২৮ কোটি ৭১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। কাজটি এখনো শেষ হয়নি। কাজের মান নিয়ে এলাকাবাসি অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। একই সড়কের আরেক অংশের কাজ ২০১৭/১৮ অর্থ বছরে ১১ কোটি ৮ লাখ টাকা ব্যয়ে অনিয়মের মাধ্যমে শেষ করা হয়েছে। আরাপপুর বাসষ্ট্যান্ড হয়ে টার্মিনাল পর্যন্ত রাস্তাটি ১৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে শুরু হয়। শুরুতেই রাস্তার কাজটি খুবই নিম্নমানের করা হয়। ইটের খোয়া কম দিয়ে তার পরিবর্তে নিন্মমানের বালি দিয়ে কাজ করার বিভিন্ন সংবাদ সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করে।
২০১৮ সালের ৩ ডিসম্বরে ১৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা ব্যায়ে মাগুরা-ঝিনাইদহ সড়কের কাজ শুরু হয়। ২০১৯ সালের ৩১ মে’র মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও কাজ এখনো শেষ হয়নি। অভিযোগ উঠেছে, এসব বড় বড় কাজ সবই পাচ্ছেন খুলনার ঠিকাদার মেসার্স মোজাহার এন্টারপ্রাইজ। কিন্তু তিনি নিজে কোনো কাজ করছেন না। ঝিনাইদহ এবং চুয়াডাঙ্গার চিহ্নিত কিছু ঠিকাদারের কাছে কাজ বিক্রি করে দিয়েছেন। অভিযোগ, ঠিকাদাররা কাজ পেয়ে সওজের কিছু প্রকৌশলী ও কার্য সহকারির যোগসাজশে অতি নিন্মমানের বালি, পাথর ও ইট দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। রহস্যজনক বিষয় হচ্ছে- ৮টি কাজের মধ্যে বড় বড় ৫ টি কাজই এই মোজাহার এন্টারপ্রাইজের নামে। তিনি কীভাবে এই কাজ নিজের নামে নিয়েছেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ঝিনাইদহ শহরের আলহেরা মোড় থেকে শেখপাড়া বাজার পর্যন্ত ৯ কিঃমিঃ রাস্তা নির্মাণে ২০ কোটি ৮৫ লাখ টাকার দরপত্র আহ্বান করা হলে কাজটি এম,এ ইঞ্জিনিয়ারিং আবেদ মুনসুর কনষ্ট্রাকশন পায়। ২০১৯ সালের ৬ জুন থেকে কাজ শুরু হয়। শুরুতেই তিনি বেশি পরিমাণ ধুলোবালি ও রাস্তার মাটির নিচ থেকে তোলা ইটের খোয়া দিয়ে রাস্তার কাজ শুরু করায় ব্যাপক সমালোচিত হন। ৩ ঝুড়ি খোয়া ও ১ ঝুড়ি বালির মিশ্রণে কাজ করার নিয়ম থাকলেও ঠিকাদার তা মানেন না ঠিকাদার। ব্যাপক অনিয়মের কারণে অফিস থেকে চিঠি দিয়ে কাজের মান শিডিউলমাফিক ভালোভাবে করার জন্য ঠিকাদারকে তাগাদা দেওয়া হয়। তারপরও কাজের মান ঠিক না হওয়ায় মৌখিকভাবে কাজটি বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ঠিকাদার আবেদ মুনসুর কাজ বন্ধ না করে তিনি তার নিজ দায়িত্বে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
ঠিকাদার আবেদ মুনসুরের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, আমি কাজ শিডিউল মোতাবেক করছি। কোন নিন্মমানের জিনিস ব্যবহার করছি না। নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ জিয়াউল হায়দার আমার নিকট মোটা অংকের টাকা ঘুষ দাবি করেছেন। আমি টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় উনি আমার বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের নিকট মিথ্যা সংবাদ প্রচার করার জন্য আমার কাজের মান নিয়ে অপপ্রচার করছেন। আমি ১০% সিকিউরিটি মানি জমা দিয়ে ৩ বছরের গ্যারান্টিতে কাজ করছি। কাজ নষ্ট হলে আমি পুনরায় এই কাজ করে দিতে বাধ্য থাকবো বলে চুক্তিবদ্ধ আছি।
সরেজমিনে উপজেলার আব্দুল লতিফ মিয়া ও পাগলাকানাই এলাকার এনামুল হোসেন বলেন, এই রাস্তায় যে পরিমাণ নিন্মমানের কাজ হচ্ছে তা এর আগে কখনো দেখি নাই।
ঝিনাইদহ সড়ক বিভাগের কার্যসহকারী মোঃ ফারুখ হোসেন অভিযোগ করে বলেন, রাস্তার কাজ খুবই নিন্মমানের হচ্ছে। এই রাস্তার পিচযুক্ত পাথরের ছালোট ট্রাকে করে নিয়ে তাদের নিজস্ব ইয়ার্ডে খোয়া ভাঙ্গা মেশিন দিয়ে নতুন পাথরের সাথে মিশিয়ে রাস্তার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই পাথর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করলে ৩ মাসের মধ্যেই রাস্তা নষ্ট হয়ে যাবে। এছাড়া ইরানি বিটুমিন ব্যবহার করা হচ্ছে।
কালীগঞ্জ উপজেলার দুলালমন্দিয়া বাজার থেকে খাজুরা, রায়পুর, যশোর হয়ে শেখ ইটভাটা পর্যন্ত ১৪.৭৫ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে ৪২ কোটি ২৩ লাখ টাকার কাজটি করছে যশোরের মেসার্স মঈনউদ্দীন বাশি লিমিটেড। এই কাজটি নিয়েও শুরু থেকেই অভিযোগ তুলে আসছে স্থানীয়রা। তারা সড়ক বিভাগ অফিসে অভিযোগও করেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বেষ্টওফওয়ানে যে বালি এবং ইটের খোয়া ব্যবহার করা হয়েছে তা খুবই নিন্মমানের অতিরিক্ত ধুলাবালি ব্যবহারের কারণে ইটের খোয়া দেখাই যাচ্ছে না। এই রাস্তায় ১২ ইঞ্চি বালি দিয়ে বেট তৈরি করার নিয়ম থাকলেও সেখানে ৮/১০ ইঞ্চির বেশী বালির থিকনেস কোথাও পাওয়া যায়নি। এছাড়া ৩ ঝুড়ি খোয়া ১ ঝুড়ি বালির মিশ্রণে দুই ধাপে ৮ ইঞ্চি বেড তৈরির নিয়ম থাকলেও কোথাও ৫/৬ ইঞ্চির বেশি পাওয়া যায়নি।
কাজটিতে চরম দুর্নীতি আর অনিয়মের কারণে নির্মান কাজ সাময়িক বন্ধ রাখার নির্দেশ দিলেও নির্বাহী প্রকোশলীকে ম্যানেজ করে কাজটি আবার শুরু করার অভিযোগ রয়েছে।
এই রাস্তার কার্যসহকারী মোঃ মোফাজ্জেল হোসেন এসব অনিয়মের কথা জানিয়ে বলেন, ঠিকাদাররা আমাদের কোনো নিষেধ তোয়াক্কা করছে না।
ঠিকাদার যশোরের মঈনউদ্দিন বাশি মুঠোফোনে বলেন, আমি এই কাজের বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না, আপনি কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে সাইডে রেজাউল আছে তার সাথে কথা বলেন বলেই ফোন কেটে দেন তিনি।
তথ্যমতে, মেসাস মঈনউদ্দিন বাশি লিমিটেড ও মেসাস ইঞ্জিনিয়ারিং আবেদ মুনসুর কনসট্রাকশন জেভির কাজ পরীক্ষা করে চরম দুর্নীতি ধরা পড়লে নির্বাহী প্রকৌশলী দপ্তর থেকে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে শোকজ করা হয়।
এসব অনিয়ম নিয়ে জানতে চাইলে ঝিনাইদহ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ জিয়াউল হায়দার বলেন, ঠিকাদারদের চাপ দেওয়ার পর তারা আগের তুলনায় এখন কাজ ভাল করছে। আর আবেদ মুনসুর সাহেব আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করছেন তা সম্পূর্ন মিথ্যা। তিনি কাজের শুরুতেই খুবই নিন্মমানের কাজ করছিলেন যে কারণে আমি উনার কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলাম।
সূত্রঃ বাংলাদেশ জার্নাল