নিজস্ব প্রতিবেদক, পীরগঞ্জ (ঠাকুরগাঁও)।।পীরগঞ্জে অবাধে চলছে ১৬ অবৈধ ইটভাটা। ফায়ারিং সার্টিফিকেট নেই কোনটিরও।প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চালানো হচ্ছে ইটভাটাগুলো। কাটা হচ্ছে ফসলি জমির উপরি ভাগের মাটি। কয়লার বদলতে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩ এবং হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে বসতবাড়ির আশে পাশে ও ফসলি জমির মাঝখানে নিয়ম বহির্ভূত ভাবে স্থাপন করা হয়েছে ইট ভাটা। আর ফসলি জমির উপরি ভাগের মাটি কেটে নিয়ে জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করা হচ্ছে। জমির উপরি ভাগের মাটি দিয়ে ইট তৈরী করে কয়লার পরিবর্তে কাঠ পুড়িয়ে দূষিত করা হচ্ছে পরিবেশ। ইট ভাটার কালো ধোঁয়ায় প্রতিবছর নষ্ট হচ্ছে আম ও লিচু গাছের মুকুল সহ বিভিন্ন ফসলের খেত। শাসকষ্ট সহ নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ছে ভাটা এলাকার সাধারণ মানুষের মাঝে। কমছে ফসলের উৎপাদন। এ উপজেলায় এরকম ১৬টি ইটভাটা রয়েছে। ফায়ারিং সার্টিফিকেট নেই কোনটিরও। বেশির ভাগ ভাটা লাইসেন্স নবায়ন ছাড়াই উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চলছে বছরের পর বছর ধরে। অথচ ২০২২ সালে ঠাকুরগাঁও জেলা সহ বেশ কয়েকটি জেলার এসব অবৈধ ইটভাটা বন্ধের আদেশ দেয় হাইকোর্ট। হাইকোর্টের এ আদেশ অমান্য করে অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও দেদারসে ইট তৈরী, পোড়ানো এবং বিক্রির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ভাটা মালিকরা। এসব দেখার যেন কেউ নেই। তবে ইউএনও বলছেন, অবৈধ ইট ভাটার বিরুদ্ধে শীর্ঘ্রই অভিযান পরিচালনা করা হবে। প্রশাসনকে ম্যানেজ করার বিষয়টি সঠিক নয়।
পীরগঞ্জ পৌর শহর ঘেঁষে চাপোড় এলাকায় গোদাগাড়ি-সিন্দুর্না এলাকায় ফসলি জমিতে ৪টি, কালিয়াগঞ্জে আবাদি জমিতে একটি, পীরগঞ্জ-বীরগঞ্জ পাকা সড়কের দু’পাশে^ বিস্তৃর্ণ ফসলের মাঠের মাঝখানে ৫টি, ভেলাতৈড় ও গনিরহাটে জনবসতি এলাকায় ৩টি, কেউটগাঁওয়ে ঘনবসতি সংলগ্ন ফসলের মাঠে একটি, মল্লিকপুরে ১টি এবং বৈরচুনায় পাকা সড়কের দু’ধারে ২টি ও আজলাবাদ এলাকায় ১টি ভাটায় প্রতি মৌসুমে ফসলি জমির উপরি ভাগের মাটি দিয়ে ইট তৈরী ও কয়লার পাশাপাশি কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানোর কাজ চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এতে উজার হচ্ছে বনাঞ্চল, কমছে ফসলি জমি, উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশিাপাশি দুষিত হচ্ছে পরিবেশ।
জসাইপাড়া গ্রামের তারেক হোসেন জানান, পীরগঞ্জে তিন ফসলী আবাদির জমির মাঝখানে ইটভাটা করা হয়েছে। ভাটার আশ পাশের আবাদি জমির উপরি ভাগের মাটি কেটে নিয়ে ইট বানানো হচ্ছে। ভাটায় কয়লার পরিবর্তে কাঠের ব্যবহার এখন মামলি ব্যাপার। এটাতে কারো নজর নেই। এর ফলে জমি কমছে, মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া জমিতে ফসল ভালো হচ্ছে না বছরের পর বছর। এতে দিন দিন ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
ভেলাতৈড় গ্রামের কামরুজ্জামান জানান, তাদের এলাকায় ভাটার ধুয়া, আগুনের ফুলকি আর ধুলা বালিতে গ্রামের অনেকের শাসকষ্ট রোগ দেখা দিয়েছে। ইট পোড়ানোর মৌসুমে এ রোগের হার বেড়ে যায়। এতে এলাকার মানুষ দীর্ঘ মেয়াদি ভোগান্তিতে পড়ছে। ভাটা বন্ধে তারা অনেকবার বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেছেন। কিন্তু কোন কাজ হয়নি।
নারায়নপুর গ্রামের আল মামুনুর রশিদ জানান, ভাটার কালো ধুয়ায় দুষিত হচ্ছে পরিবেশ। আশপাশের আম, লিচু বাগানের মুকুল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। হাওয়া ভাটার গরম বাতাশে ধান সহ অন্যান্য ফসল ঝলসে যাচ্ছে। কোন প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩ অনুযায়ী, আবাসিক এলাকা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাটবাজার ও ফসলি জমির এক কিলোমিটারের মধ্যে ইট ভাটা স্থাপন করা যাবে না এবং ইট তৈরীর ক্ষেত্রে আবাদি জমির উপরি ভাগের মাটি ব্যবহার নিষিদ্ধ। ইট পোড়ানোর ক্ষেত্রে কাঠ কিংবা বাঁশ পোড়ানো যাবে না। আবাদি জমির উপরি ভাগের মাটি ব্যবহার করে ইট তৈরী করলে প্রথমবার দু’বছরের কারাদন্ড ও ২ লাখ টাকা জরিমান এবং এর পরবর্তীতে আবার ব্যবহার করলে দুই থেকে দশ বছরের জেল সেই সাথে দুই থেকে দশ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করলে অনধিক তিন বছরের কারাদন্ড বা তিন লাখ টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু এ উপজেলায় কোন ভাবেই এসব নিয়ম মানা হচ্ছে না।
এ বিষয়ে বিএসসি ব্রিক্স ভাটার মালিক রেজওয়ানুল হক বিল্পব বলেন, আমরা সরকারকে ভ্যাট, ট্যাক্স দিয়েই ইট ভাটা চালাচ্ছি। শুধু ফায়ারিং সার্টিফিকেট নাই। এভাবেই চলছে ভাটা গুলো। এর বেশি কিছু বলতে পারবো না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ইট ভাটা মালিক জানান, স্থানীয় ও জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, শুল্ক বিভাগ, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা ও কিছু সাংবাদিককে ম্যানেজ করেই ইটভাটার এ অবৈধ কর্মযজ্ঞ চালানো হচ্ছে। প্রশাসন সহ সব শ্রেণীকেই হাত করে ইট ভাটা চালাচ্ছেন তারা।
এ বিষয়ে পীরগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি জয়নাল আবেদিন বাবুল বলেন, অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য উপজেলা আইন শৃঙ্খলা সভায় উপস্থাপন করা হলেও এখনো কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এটা দুঃখ জনক। সব সাংবাদিককে ম্যানেজ করার বিষয়টি সঠিক নয়।
এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলার দায়িত্বে থাকা পঞ্চগড় পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক ইউসুফ আলী’র সাথে মুঠোফনে কয়েকবার ফোন করা হলে তার (০১৭৩৬১৯১২১৪) মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
অভিযোগ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার রমিজ আলম বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের সাথে যোগাযোগ করে অবৈধ ইট ভাটার বিরুদ্ধে শীর্ঘ্রই অভিযান পরিচালনা করা হবে। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ইটভাটা চালানোর অভিযোগ সঠিক নয়।