রাজশাহী :- গ্রীষ্ম মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির সংকট দেখা দেয়। সেইসময়ে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নলকূপ অপারেটররা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের সেচের পানির জন্য দিনের পর দিন কালবিলম্ব করতে থাকে।ফলে উর্দ্ধতন কর্তাদের যথাযথ নজরদারির অভাবে অনেক বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গভীর নলকূপ ও সেচ যন্ত্রের অপারেটরেরা ক্ষুদ্র কৃষকদের তাদের সেচের ন্যায্য পানি থেকে বঞ্চিত করছে।
কৃষকদের অভিযোগ, অপারেটরা তাদের পাম্প থেকে পানি দিতে দেরি করে। এতে ক্ষুদ্র কৃষকেরা ঘন ঘন ফসলের ক্ষতির মুখে পরে। তারা এমন এক ফাঁদে পরে যায় যে একসময় আর পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে না। বাধ্য হয় নিজের জমি বিক্রি করে দিতে বা অন্যের কাছে জমি বর্গা দিতে বাধ্যহয়।
অনেকক্ষেত্রে নলকূপ অপারেটররা যাদের অর্থ ও রাজনৈতিক প্রভাব আছে তারা এই জমিগুলো কিনে নেয় বা নিজেদের ফসল ফলানোর জন্য ইজারা নেয়। এর ফলে অনেক কৃষক পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকার তগিদে কৃষিকাজ ছেড়ে দিনমজুরে পরিণত হচ্ছেন।
বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষক, কৃষি বিশেষজ্ঞ এবং উন্নয়ন কর্মীদের থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, সচ্ছল কৃষক বা বহিরাগত ব্যবসায়ী যারা গ্রামে বিপুল পরিমান জমি লিজ নিয়ে কৃষিকাজ করে, নলকূপ অপারেটররা অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে তাদের সময়মতো সেচের পানি দেয়। এজন্য তারা অনেক সময় নলকূপের আওতাভূক্ত জমির বাইরে গিয়ে হলেও বড় কৃষকদের সেচের পানি দেয় ,ফলে ক্ষুদ্র কৃষকের নায্য সেচ পানির থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এরকম এক গভীর নলকূপ চালকের হয়রানীর প্রতিবাদে গত ২৩ মার্চ রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ইশ্বরীপুর গ্রামে জমির গভীর নলকূপের পাশে দাঁড়িয়ে কীটনাশক পান করেন দুই কৃষক। তাদের একজন অভিনাথ মার্ডি (৩৬) সেই রাতেই বাড়িতে মারা যান এবং অন্যজন রবি মার্ডি (২৭) শুক্রবার হাসপাতালে মারা যান। তারা ছিলেন চাচাতো ভাই এবং সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর।
এ ঘটনায় শুক্রবার রাতে অভিনাথের স্ত্রী রোজিনা হেমব্রম বাদী হয়ে নলকূপ অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনকে আসামি করে স্বামীর আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে গোদাগাড়ী থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, সেচের পানি চাইবার পরও সাখাওয়াত টানা ১২ দিন অভিনাথের খেতে পানি সরবরাহ করেনি। তবে অভিনাথের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পরলে নলকূপ অপারেটর তাদের দুজনের জমিতে রাতে পানি দিয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনি বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারোয়ার জাহান বলেন, আমরা লক্ষ্য করেছি বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে সেচের পানি নিয়ে এক ধরনের সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হচ্ছে। কৃষকরা বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে এই সামন্তবাদীদের কাছে ফসল এবং জমি হারাচ্ছে। অনেক নলকূপ অপারেটর এই অঞ্চলের পানি সংকটের সুযোগ নিয়ে কৃষকদের শোষণ করছে।
তিনি বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল ও গোমস্তাপুর উপজেলা, রাজশাহীর তানোর ও গোদাগাড়ী এবং নওগাঁর পোরশা, সাপাহার ও নিয়ামতপুর উপজেলায় পানির তীব্র সংকট রয়েছে। নওগাঁর কৃষকরা ধান আবাদ ছেড়ে আম আবাদে ঝুঁকে পরলেও, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষুদ্র কৃষকরা সারা বছরের খাবারের জন্য বোরো ধান আবাদ করে থাকেন। বোরো আবাদে অন্য যে কোনো ফসলের চেয়ে বেশি সেচের দরকার হয়।
ইশ্বরিপুর গ্রামের কৃষক বিমল হাসদা জানান, তার বোরো খেতে পানি পেতে ১৫ দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমার কমপক্ষে দুই ঘণ্টার জন্য পানির প্রয়োজন ছিল, কিন্তু দেয়া হয়েছিল মাত্র এক ঘণ্টার। ফলে এবারও ফলন খারাপ হতে পারে। যেমনটা গত বছরও হয়েছিল। এরকম চলতে থাকলে আমার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকবে না। কৃষি ছাড়া অন্য কাজও জানি না। ফসলের ক্ষতি হলে আমি কী খাব পরিবারকে কী খাওয়াবো,’ বলেন বিমল।
বিমল আরও বলেন, পানির জন্য দিনের পর দিন ঘুরতে থাকি। অপারেটরের হাতে পায়ে ধরি। এমনিতেই ফসলের দাম পাওয়া যায় না, তার ওপর পানির অভাবে ফলন কমে গেলে ক্ষতি বেড়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, আদিবাসী কৃষকদের ভোগান্তি অন্য ক্ষুদ্র কৃষকদের থেকে বেশি। আমাদের দিনের বেলা কখনোই পানি দেয় না। আবার রাতে পানি দেবে বলে রাতের পর রাত জাগিয়ে রেখে দুই সপ্তাহ পার করে দেয়। আমরা দিনের বেলা কাজ করে রাতেও জমিতে বসে থাকি।
সরকারের বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে ১৬ হাজার গভীর নলকূপ ও সেচযন্ত্র পরিচলনার জন্য অপারেটর নিয়োগ করে। এই নলকূপ প্রকল্প থেকে বিএমডিএ বছরে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে।
বিএমডিএ সূত্র জানায়, এই নলকূপগুলোর অর্ধেকেরও বেশি বরেন্দ্র অঞ্চলের তিন জেলা রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁয়। এ তিন জেলায় সেচের পানির অভাব রয়েছে। ছাড়াও এই তিন জেলায় উপজেলা সেচ কমিটির অনুমোদিত প্রায় ৫৬ হাজার ব্যক্তিগত নলকূপ রয়েছে।
কৃষকরা জানান, সেচের পানি সুষ্ঠু বিতরণের জন্য বিএমডিএ কৃষকদের স্মার্ট কার্ড দিয়েছে। স্মার্টকার্ডে টাকা রিচার্জ করে নলকূপের ঘরে রাখা মেশিনে কার্ড পাঞ্চ করলে তাদের জমিতে পানি যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে খুব অল্প কয়েকজন নলকূপ অপারেটর কৃষকদের তাদের স্মার্টকার্ড ব্যবহার করতে দেয়। বরং অপারেটররা নিজেদের কার্ড ব্যবহার করে নগদ টাকায় কৃষকদের পানি নিতে বাধ্য করে।
বিএমডিএর গভীর নলকুপ ও সেচযন্ত্র শাখার অতিরিক্ত পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, তারা এ বিষয়ে কৃষকদের কাছ থেকে মাঝে মধ্যেই অভিযোগ পান। আমরা প্রতি বছর এক বা দুজন অপারেটরকে সরিয়ে দিই, কিন্তু বেশিরভাগ অভিযোগ আসেই না। আমরা বিষয়টি দেখব, বলেন তিনি।