ভারতের উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারি অধ্যাপক এবং বিশেষকরে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক রাজনৈতিক গবেষক ড. আবান্তিকা কুমারী পাকিস্তানের ‘দ্য গ্লোবাল ভিলেজ স্পেস’ পত্রিকায় গত ১৫ জুন ২০২২ লিখেছেন, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজমান। এখানে সকল ধর্মের মানুষ একত্রিত হয়ে আদিকাল থেকেই যার যার ধর্ম পালন করে আসছে। মুসলমানরা মোট জনসংখ্যার ৯০%, তবে, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টানরাও শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করছে। বাংলাদেশের জনগণের জন্য এটি অবশ্যই দক্ষিণ এশিয়ায় গর্বের বিষয়।
বাংলাদেশে ১৬০ মিলিয়ন মানুষ বসবাস করে, যারা বহু-ধর্মীয়, বহু-জাতিক এবং বহুভাষিক। বাংলাদেশের সংবিধান সকল নাগরিককে স্বাধীনভাবে এবং শান্তিপূর্ণভাবে তাদের নির্বাচিত ধর্ম পালনের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে। সম্ভাব্য অনুমান অনুসারে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যার প্রায় ১২%। এর মধ্যে হিন্দুরা জনসংখ্যার ১০%, বৌদ্ধরা ১%, খ্রিস্টানরা ০.৫০% এবং জাতিগত সংখ্যালঘুরা ১% এরও কম।
ড. আবান্তিকা তার নিবন্ধে লিখেছেন, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ কীভাবে একসাথে বসবাস করতে পারে, সহযোগিতা করতে পারে তার বাস্তব উদাহরণ বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যে দেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা, সম্প্রীতি এবং সহনশীলতার মূল্য দেয়া হয়। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং জাতিগত গোষ্ঠীর বিভিন্ন বৈচিত্র্য দ্বারা গঠিত। এই ধরনের সম্প্রদায় এবং গোষ্ঠীগুলো সম্প্রীতিতে বাস করে। তাদের পার্থক্যকে দূরে রেখে ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিকে আলিঙ্গন করতে এবং সম্মান করতে শেখে যা বাংলাদেশের সমতায় অবদান রেখেছে।
তিনি লিখেছেন, অটুট সামাজিক ও ধর্মীয় শান্তির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। এই দেশটি তাদের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি নির্বিশেষে সবার মধ্যে সহনশীলতা এবং শ্রদ্ধার সমৃদ্ধ সংস্কৃতির কারণে সামাজিক সম্প্রীতির উদাহরণ। তাদের উদার মনোভাব জাতির সমন্বয়ে অবদান রেখেছে।
শেখ হাসিনা সরকার সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়েছে এবং ঢাকার বিখ্যাত ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পূর্বে হারিয়ে যাওয়া সম্পত্তি পুনরূদ্ধারে সহায়তা করেছে। সারা বিশ্বের বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীদের সেবা করার জন্য বাংলাদেশ নেপালের লুম্বিনিতে একটি বৌদ্ধ তীর্থস্থানও নির্মাণ করছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশাসন ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের সকল মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা এবং গুরুদোয়ারা পরিচালনা করে।
কেউ কি কল্পনা করতে পারে একটি মুসলিম দেশ নেপালে (ধর্মীয়ভাবে হিন্দু দেশ) একটি বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ করছে? সম্প্রতি নির্মিত এই বিহার বিশ্বের সকল দেশের জন্য একটি সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যে, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বের জন্য রোল মডেল। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হিসেবে বজায় রাখতে আগ্রহী।
উদাহরণ স্বরূপ, মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের ভিন্ন ধর্মের দুই ব্যক্তি- একজন হিন্দু এবং একজন মুসলমান একে অপরের ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নজির স্থাপন করেছেন। বাগেরহাট জেলায় একজন হিন্দু ব্যক্তি একটি মসজিদ নির্মাণের জন্য সম্পত্তি দান করেছেন এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের ৯ জন মুসলমান নেতা তাদের জমির একটি অংশ শ্মশান হিসাবে ব্যবহারের জন্য দান করেছেন। যাতে হিন্দুরা তাদের সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে এই স্থানটি ব্যবহার করতে পারে।
বাংলাদেশকে বিশ্বের চ্যাম্পিয়ন এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রোল মডেল হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। মানুষ দীর্ঘদিন ধরে আন্তঃসাম্প্রদায়িক শান্তিও আস্থা নিয়ে এখানে বসবাস করে আসছে। বিশ্ব বাংলাদেশের আন্তঃসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা জানে এবং প্রশংসা করে। বাংলাদেশীরা ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ নীতি মেনে চলে; সকল ধর্মের প্রতি সকলের সমান শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে।’
বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে সকল জাতিগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট। আন্তঃসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাঙালি সংস্কৃতির সমার্থক। এটি বিশ্বের কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি যেখানে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এবং বিভিন্ন জাতিগত উপজাতি শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার আন্তঃসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী। তিনি ধর্মীয়ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। যে কেউ দেখতে পারেন যে তিনি সমস্ত গোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় নিবেদিত। শেখ হাসিনার সরকার এটা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রƒতিবদ্ধ।
রমজান মাসে ঢাকার একটি বৌদ্ধ বিহারের সামনে প্রতিদিন শত শত মুসলিম পুরুষ, মহিলা এবং শিশু ইফতারের জন্য সারিবদ্ধ হন। ঐ বৌদ্ধ বিহারের ধর্মরাজিকা মুসলমানদের পবিত্র মাসে সন্ধ্যাবেলায় ইফতারের আয়োজন করে।
বৌদ্ধ বিহারের উদ্যোগে দরিদ্র ও নিঃস্ব মুসলমানদের খাদ্য বিতরণের এই দৃষ্টান্ত দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশে দু’টি ভিন্ন ধর্মের দ’ুটি গোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
বিভিন্ন ধর্মীয় ছুটির দিন যেমন মুসলিম সম্প্রদায়ের ঈদ, হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বড়দিন এবং বুদ্ধ পূর্ণিমার মঙ্গল শোভাযাত্রা বা নববর্ষের প্রথম দিনে ভোরবেলায় বাঙালির মঙ্গল শোভাযাত্রা একযোগে অনুষ্ঠিত হয়। মুসলিম উৎসব যেমন ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, মিলাদুন্নবী, মহররম, চাঁদের রাত, শব-ই-বরাত এবং বিশ্ব ইজতেমা; হিন্দু উৎসব যেমন দুর্গাপূজা এবং জন্মাষ্টমী; বুদ্ধ পূর্ণিমার বৌদ্ধ উৎসব; খ্রিস্টানদের বড়দিনের উৎসব; এবং ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব যেমন পহেলা বৈশাখ, নবান্ন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে রবীন্দ্র জয়, বাঙালি এবং অবাঙালিরা উপজাতীয় ছুটি উদযাপন করে যেমন বিজু, সাংগরিয়া, বৈসাবি এবং অন্যান্য। বাংলাদেশের কোনো ধর্মীয় বা জাতিগত সীমানা নেই। এখানে সবাই সবার জন্য, কোন ব্যবধান নেই।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমি সাধারণত বলি যে ধর্ম একটি ব্যক্তিগত বিষয়, কিন্তু উৎসব সবার জন্য উন্মুক্ত। শান্তি এবং বন্ধুত্ব আমাদের গর্ব।’
তিনি আরো বলেন, এখানে হাজার হাজার বছর ধরে যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রয়েছে তা যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে।
ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান এই চারটি ধর্ম এই দেশের প্রধান ধর্ম। মুসলমানরা জনসংখ্যার প্রায় ৮৮.৩ শতাংশ। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা সুন্নি; যদিও শিয়া মুসলমানরা মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় ৩%। জনসংখ্যার প্রায় ১০% শতাংশ হিন্দু। বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরা অন্যদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ।
দুর্গাপূজা হিন্দুরা পালন করে, ক্রিসমাস পালন করে খ্রিস্টান এবং বৌদ্ধরা পালন করে বুদ্ধ পূর্ণিমা, অন্যান্য সম্প্রদায় পালন করে অন্যান্য ছুটি। এই উদযাপনগুলো কেবল ধর্মের ছাপই নয়, সমাজ ও জাতির ছাপও প্রতিফলিত করে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের স্লোগান ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’ তার ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের সাক্ষ্য হিসাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এটি একটি নজির স্থাপন করেছে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
সরকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উদযাপনের জন্য যথেষ্ট নিরাপত্তা দিয়ে থাকে, যেমন দুর্গা পূজা। ২০১৭ সালে সারা দেশে ৩০,০০০ টিরও বেশি মন্ডপে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যার সবকটিই বিনা বাধায় সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশে এ বছর ৩১,২৭২টি মন্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। এটি শুধুমাত্র হিন্দু সংখ্যালঘুদের মধ্যে নয়, দেশের নিরাপত্তার সাধারণ অনুভূতিকে প্রতিফলিত করে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক উদার বাঙালি সংস্কৃতি এবং দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তি থাকা সত্ত্বেও কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থা ক্ষমতায় রয়েছে তার উপর নির্ভর করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার দেশের অসাম্প্রদায়িক ভিত্তি বজায় রাখতে এবং উন্নত করতে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের একটি নির্দেশিকা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেছিল।
এরপর আ.লীগ যখনই ক্ষমতায় ছিল, এই আদর্শ রক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও কল্যাণের চেষ্টা করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম (সিএইচটি) শান্তি চুক্তি, ১৯৯৭ সালে পিএমএসএইচ দ্বারা স্বাক্ষরিত এই অঞ্চলে শান্তি প্রচেষ্টার একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত।
বাংলাদেশে প্রত্যেকের সমান অধিকার রয়েছে এবং কাউকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত করা হয় না। কক্সবাজারের রামু উপজেলায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর হামলা এবং কুমিল্লার বিভিন্ন মন্দিরে হামলা বাংলাদেশে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কখনও কখনও একটি নেতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে, যেমন জাল ফেসবুক আইডিগুলো আগে সাম্প্রদায়িক আক্রমণের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা হ্রাস এবং নিপীড়নের বিষয়ে কিছু ভুল ধারণা, ভুল তথ্য এবং অপপ্রচার রয়েছে যা একেবারেই সত্য নয়। এই ধারণা সম্পূর্ণ মিথ্যা। অন্যায়ভাবে এবং ভিত্তি ছাড়াই বাংলাদেশকে এমন একটি জাতি হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে যে এখানে সংখ্যালঘুদের বিশেষ করে হিন্দুদের প্রতি বৈষম্য হয়। বিচ্ছিন্ন ঘটনা সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের মানসিকতার প্রতীক হতে পারে না। ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা নিয়মিত বেশ কয়েকটি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের আশ্বস্ত করেন যে তারা যে কোনো ক্ষতির জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষা এবং ক্ষতিপূরণ পাবেন। বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি উপলব্ধি করার অনেক উপায় রয়েছে। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশ একটি মধ্যপন্থী মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করছে। সব ধর্মের মানুষের সমাগম হয় এই স্থানে। প্রাচীনকাল থেকেই এই প্রথা চলে আসছে। মুসলমানরা জনসংখ্যার প্রায় ৯০%, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টানরাও এখানে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করছে। এটি দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের মানুষের জন্য গর্বের বিষয়।বাসস