সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নার্সিং কলেজসমূহের বিএসসি ইন নার্সিং পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনায় একটি নার্সিং কলেজের সাবেক অধ্যক্ষসহ প্রশ্ন ফাঁস চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-১০।
রবিবার (২১ আগস্ট) রাতে রাজধানীর মহাখালী, ধানমন্ডি ও আজিমপুর এলাকা হতে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মূল হোতা ফরিদা খাতুন, মোছাঃ মনোয়ারা খাতুন, মোসাঃ নার্গিস পারভিন, মোছাঃ কোহিনুর বেগম, মো. ইসমাইল হোসেন ও মো. আরিফুল ইসলাম।
এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্রের কপি এবং ৯টি মোবাইল। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা বর্ণিত প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য প্রদান করেছে।
আজ সোমবার (২২ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বিস্তারিত জানান।
র্যাব জানায়, গত ২০ আগস্ট অনুষ্ঠিতব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নার্সিং কলেজের ১ম বর্ষ ফাইনাল বিএসসি ইন নার্সিং (পোস্ট বেসিক) পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরীক্ষা শুরু হওয়ার পূর্বেই আদান প্রদান করার প্রমাণ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি দল ২০ আগস্ট পরীক্ষা শুরুর পূর্বে একটি নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থীদের মোবাইলে প্রশ্নপত্রের ছবি ও সাদা কাগজে হাতে লেখা প্রশ্নপত্রের ছবি উদ্ধার করে। ফলশ্রুতিতে র্যাব প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।
গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সর্বমোট ৯৮টি নার্সিং কলেজ এর মধ্যে বর্তমানে ৩৮টি কলেজে পরীক্ষা চলমান। প্রশ্নপত্রের গোপনীয়তা বজায় রাখতে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ০২ জন প্রশ্ন প্রণয়নকারী নিয়োগ দেওয়া হয় যারা দুই সেট আলাদা প্রশ্নপত্র সরবরাহ করে থাকেন। পরবর্তীতে এই প্রশ্নপত্রগুলোকে যাচাই-বাঁচাই করার জন্য একটি মডারেটর টিম নিয়োগ করা হয়। যাদের কাজ হচ্ছে প্রশ্নপত্রগুলো থেকে পরীক্ষার জন্য এক সেট পরিপূর্ণ প্রশ্নপত্র তৈরি করে সেগুলো সিলগালার মাধ্যমে চিকিৎসা অনুষদের ডিনের কাছে জমা দেয়। পরবর্তীতে চিকিৎসা অনুষদের ডিন বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্রের প্রশ্নপত্র সরবরাহের জন্য ৪ সদস্যদের একটি গোপনীয় টিম নিয়োগ করে থাকেন; যারা নির্বাচিত প্রশ্নপত্রটি প্রিন্টিং এবং প্যাকিংয়ে নিযুক্ত থেকে পরীক্ষা কেন্দ্রের চাহিদা অনুযায়ী প্রশ্নপত্রগুলো প্রিন্ট করে আলাদা আলাদা প্যাকিং করে তার উপড়ে কেন্দ্রের নাম লিখে সিলগালা করে দেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই প্রশ্নপত্রগুলো বিভিন্ন কেন্দ্রে বিতরণ করে থাকেন।
জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, এই চক্রের মূল হোতা গ্রেপ্তারকৃত ফরিদা খাতুন। তিনি রাজধানী মহাখালীর একটি নার্সিং কলেজের কম্প্রিহেন্সিভ নার্সিং এন্ড প্যাথলজি বিষয়ের প্রশিক্ষক। প্রায় ১০ বছর যাবৎ এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রিন্টিং ও প্যাকিং এর দায়িত্বে থাকেন। চক্রের অপর সদস্য গ্রেপ্তারকৃত নার্গিস ও মনোয়ারা বেগম তার অন্যতম সহযোগী। তারা পরস্পর যোগসাজশে বেশ কিছুদিন যাবৎ শিক্ষকতার আড়ালে উক্ত প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছেন। গ্রেপ্তারকৃত ফরিদা খাতুন গত ২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য বিএসসি ইন নার্সিং (পোস্ট বেসিক) প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষায় চিকিৎসা অনুষদের ডিন কর্তৃক নির্বাচিত ৪ সদস্যদের গোপনীয় টিমের একজন সদস্য ছিলেন। গত ১৩ আগস্ট গ্রেপ্তারকৃত নার্গিস ও মনোয়ারা বেগম ফরিদা খাতুন এর নিকট কম্প্রিহেন্সিভ নার্সিং এন্ড প্যাথলজি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র চাইলে ফরিদা খাতুন প্রিন্টিং ও প্যাকিং এর সময় সংগ্রহ করে রাখা প্রশ্নপত্র গ্রেপ্তারকৃত নার্গিস ও গ্রেপ্তারকৃত মনোয়ারা বেগম প্রদান করে। পরবর্তীতে তাদের এই চক্রের আরেক সদস্য প্রশ্নপত্রটি গ্রেপ্তারকৃত ইসমাইলের মাধ্যমে কোহিনূর বেগমের নিকট প্রদান করে। এ সময় ইসমাঈল কিছু কপি নিজের কাছে রেখে দিয়ে অর্থের বিনিময়ে তার ঘনিষ্ঠজনদের নিকট সরবরাহ করে। পরবর্তীতে কোহিনূর বেগম ও আরিফ প্রশ্নপত্রটি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিকট অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরীক্ষার পূর্বেই প্রশ্নপত্র পৌঁছে দেন।
গ্রেপ্তারকৃত ফরিদা, মনোয়ারা, নার্গিস বিগত প্রায় ১০ বছর যাবৎ একটি নার্সিং কলেজের প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত। তারা ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নার্সিং কলেজসমূহের বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটি, মডারেটর ও ডিন কর্তৃক নির্বাচিত প্রশ্নপত্র প্রিন্টিং এবং প্যাকিং এ নিযুক্ত গোপন টিমের সদস্য ছিলেন। গ্রেপ্তারকৃত কোহিনুর বেগম ২০০৮ সাল হতে ঢাকার একটি সরকারি নার্সিং কলেজে নার্সিং প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে অবসরে যাওয়ার পর একটি বেসরকারি নার্সিং কলেজে প্রিন্সিপাল হিসেবে যোগদান করেন। গ্রেপ্তারকৃত ইসমাইল হোসেন রাজধানীর একটি নার্সিং কলেজের সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে কর্মরত এবং গ্রেপ্তারকৃত আরিফ ঢাকার একটি নার্সিং কলেজের পোস্ট বেসিক বিএসসি ইন নার্সিং এর প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তারা গত ২০ আগস্ট অনুষ্ঠিত কম্প্রিহেন্সিভ নার্সিং এন্ড প্যাথলজি বিষয়ে প্রশ্নপত্রটি ফাঁস চক্রের অন্যতম সদস্য কোহিনূর বেগম এর নিকট থেকে সংগ্রহপূর্বক বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের নিকট অর্থের বিনিময়ে সরবরাহ করে। গ্রেপ্তারকৃত আরিফ ২০১৭ সালের সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করার অপরাধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করে। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।