খেলাপি ঋণের বেশির ভাগই ব্যালেন্স শিটনির্ভর। ব্যাংকগুলো ব্যালেন্স শিটনির্ভর অর্থায়নে মগ্ন। এই ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় লাঞ্চ বা ডিনারে বসে। বেক্সিমকো ও এস আলম এখন বেতন দিতে পারছে না। অথচ ব্যালেন্স শিট দেখে এসব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে ব্যাংক। তখন সম্পদ দেখা হয়নি। এখন এই প্রতিষ্ঠানের ব্যালেন্সশিট যাচাই করে দেখা যাচ্ছে সবই ফাঁকা। এভাবে ঋণ দেওয়া কতটা যৌক্তিক সে প্রশ্ন তুলেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
তিনি বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকল্প নেই। এই খাতে ব্যাংকের ঋণ দিতে আগ্রহ নেই বললে চলে। তাই নতুন নীতিতে এই খাতে অর্থায়নের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি সোলার স্থাপনের জায়গা ও সঞ্চালন লাইনে যুক্ত হওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে সরকার।
ফাওজুল কবির বলেন, সরকার সব বিদ্যুৎ এককভাবে কিনে ভর্তুকি দিয়ে বিক্রি করবে এমন নীতি থেকে বের হয়ে আসবে। মার্চেন্ট বিদ্যুৎ নীতি গ্রহণ করা হবে। বিনিয়োগকারী বিদ্যুৎ উৎপাদন করবেন এবং তারাই বিক্রির জন্য গ্রাহক ঠিক করবেন। কারণ সরকার স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের (আইপিপি) থেকে সরে আসতে চায়। সরকার ১০ থেকে ২০ শতাংশ আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ কিনবে। কারণ আইপিপির ক্রেতা সরকার হওয়ায় এখন টাকা দিতে পারছে না। এই নীতি থেকে সরে আসবে সরকার।
শনিবার পল্টনে অর্থনীতি বিটের সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) মিলনায়তনে আয়োজিত ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি রূপান্তরে অভ্যন্তরীণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা জানান উপদেষ্টা।
ইআরএফ, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ, কোস্টাল লাইভলিহুড অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (ক্লিন) ও বিডব্লিউজিইডি যৌথভাবে এ সেমিনারের আয়োজন করেছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৩ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির কত? বরং বেশির ভাগই অন্যান্য খাতে। অথচ ব্যাংকগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ঋণ দিতে এগোয়নি। তারা ব্যালেন্স শিটনির্ভর অর্থায়নে মগ্ন। সম্প্রতি বেক্সিমকো ও এস আলমের কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছে না। এদের ব্যালেন্স শিট ফাঁকা। অথচ তাদের খেলাপি ঋণই বেশি। তাই ব্যালেন্স শিটনির্ভর ঋণ দেওয়া কতটা যৌক্তিক। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে কেন অর্থায়ন করছে না ব্যাংক। এ সমস্যার সমাধান বিগত সরকার আন্তরিকভাবে চায়নি। এমনকি নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার হোক তাও চায়নি। তাই অর্থায়ন সমস্যা রয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার নতুন নীতির মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান করবে।
তিনি বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের অসাধু উদ্যোক্তাদের মতো সাধারণ ও প্রকৃত উদ্যোক্তারা বড় হোটেলে লাঞ্চ বা ডিনারে যেতে পারেন না। ফলে তাদের জন্য ঋণ পাওয়া সহজ হয় না। ব্যাংকগুলোকে সম্পদ বিবেচনা করে ঋণ অনুমোদন করার পরামর্শ দেন জ্বালানি উপদেষ্টা।
ফাওজুল কবির খান বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে সরকার রেল, সড়কসহ বিভিন্ন খাতের অব্যবহৃত জমি ব্যবহার করবে। এজন্য শিগগিরই একটি নীতি করা হবে।
উপদেষ্টা বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার ঘটুক, এটি আগের সরকার আন্তরিকভাবে চায়নি। দেশে এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে যেতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তি ছাড়া দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য সোলার স্থাপন করা যাবে না, জায়গা নেই এমনটা বলা হতো। এটি ভ্রান্ত ধারণা। বরং জোর করে মানুষের জমি নিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে। এটা বন্ধ করতে চাচ্ছি। অব্যবহৃত জমি নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের ইকুইপমেন্ট আমদানি শুল্ক কমানো হবে না। স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে তোলার জন্য সরকার এ খাতে শুল্ক রাখবে।
তিনি বলেন, ইকোনমিক জোন নির্মাণের নামে সাধারণ মানুষের হাজার হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করলেও সেখানে কিছুই করা হয়নি। এতে সৃষ্টি হয়নি কর্মসংস্থানও।
এছাড়া অর্থায়ন সংকট ও কারিগরি প্রযুক্তির অভাবও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের ক্ষেত্রে সমস্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রকৃত সমস্যা কোথায়, সেটি চিহ্নিত করা দরকার। বর্তমান সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে রেল, সড়কসহ বিভিন্ন খাতের অব্যবহৃত জমি ব্যবহার করবে। আর আওয়ামী লীগ সরকার বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রয়োগ করে নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার জন্য যেসব সম্মতিপত্র দিয়েছিল সেগুলো এখন আর প্রযোজ্য হবে না বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির প্রধান সমস্যা সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার অভাব। এজন্য সব উন্মুক্ত করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন আর সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করার জন্য মন্ত্রী, সচিবদের আত্মীয় হওয়া লাগবে না, চেনা লাগবে না।
তিনি আরও বলেন, ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে পদ্মা রেল সেতু করা হয়। কিন্তু যেভাবে আয় হওয়ার কথা বলা হয়েছে সেটি বাস্তবে হবে না। কার্যত এভাবেই বেপরোয়া অপচয় করা হয়েছে। তারা টাকা ব্যয় করে জিডিপি বাড়িয়েছে। আর আমরা খরচ কমাচ্ছি। এতে জিডিপি কমবে।
অনুষ্ঠানে সিপিডির গবেষণা পরিলাচক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে অর্থায়ন সহজ করতে হবে। বিশ্বব্যাপী ১৮ ধরনের ঋণ উপকরণ অনুসরণ করা হয়। বাংলাদেশে শুধু নন-কনসেশনাল ঋণ দেওয়া হয়। ফাইন্যান্সিয়াল উপকরণ বাড়াতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ আসার পথ সুগম করতে হবে।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চের চেয়ারপারসন গৌরাঙ্গ নন্দী। তিনি সহজে অর্থায়নের জন্য একটি বিশেষ তহবিল গঠনের প্রস্তাব করেন। পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত বাড়তি বিদ্যুৎ সরকারের কাছে বিক্রির ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেন তিনি।
ইআরএফের সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা’র সভাপতিত্বে ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন দ্য সিটি ব্যাংকের চিফ ইকোনমিস্ট ও কান্ট্রি বিজনেস ম্যানেজার মো. আশানুর রহমান, ক্লিনের চিফ এক্সিকিউটিভ হাসান মেহেদী প্রমুখ।