জিয়া উদ্দিন ওরফে জামান। নিজেকে ১২টি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে দাবি করতো। অস্ট্রেলিয়া, চায়না, হংকং, ওমানসহ দুবাইতে তার বিভিন্ন ব্যবসা রয়েছে বলে ভূয়া প্রচারণা চালাতো। ২০১৪ সালে তার ফোসান সিরামিক লিমিটেড স্যানিটারি প্যাড, হাইলেডি স্যানিটারি ন্যাপকিনসহ বিভিন্ন পণ্যের আকর্ষনীয় টিভিসির মাধ্যমে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করেও সে প্রতারিত করত, এবং এসব আমদানির ক্ষেত্রে অধিক মূল্য দেখিয়ে সে বিদেশে অর্থ পাচার করে। তার এ সব ব্যবসায়িক অংশীদার বানানোর লোভ দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যবাসায়িক অংশীদারের প্রস্তাব দিয়ে সে প্রায় শতাধিক মানুষের কাছ থেকে প্রায় ১৭০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। প্রতারণার কৌশল হিসেবে ব্যবসায়ীদের দামি এবং আকর্ষণীয় গিফট প্রদান করত। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা পাচার করেছে বলেও জানায়।
প্রতারণার এসব অভিযোগের ভিত্তিতে সোমবার রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১ এর অভিযানে রাজধানীর উত্তরা থেকে মো. জিয়াউদ্দিন ওরফে জামানকে (৫৫) গ্রেপ্তার করা হয়।
অভিযানে উদ্ধার করা হয় বিভিন্ন ব্যাংকের ৩৭টি চেক বই, ৬ বোতল বিদেশি মদ, ৯৯ হাজার টাকার জালনোট, ৬ হাজার জাল ইউএস ডলার, প্রতারণামূলক কার্যকলাপের জন্য ফোসান সিরামিক প্ল্যান্ট এবং জিয়া টাওয়ারের কাঠামোগত ভবিষ্যত পরিকল্পনা, ওমানে অর্থ পাচারের তথ্যাদি, প্রতারণামূলক কার্যকলাপের জন্য ‘জাপানে তৈরি’ স্টিকার, ৫ ধরনের আইডি এবং বিজনেস কার্ড, নগদ ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা এবং ২০০ কোটি টাকা নেওয়ার ভবিষ্যত পরিকল্পনা সংক্রান্ত নথিপত্র।
মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব সদরদপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, জিয়া উদ্দিন ১২টি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বা এমডি হিসেবে দাবি করে থাকেন। সে নিজেকে জাহির করার লক্ষ্যে এ ধরণের তথ্য সম্বলিত ভিজিটিং কার্ড তৈরী করেছে। এছাড়াও তার অস্ট্রেলিয়া, চায়না, হংকং, ওমান ও দুবাই এ বিভিন্ন ব্যবসা রয়েছে বলে ভূয়া প্রচারণা চালায়। সে বিভিন্ন ব্যক্তিকে কৌশলে প্রলুব্ধ করে ব্যবসায়িক পার্টনার বানানোর নামে বিপুল পরিমান অর্থ আত্মসাৎ করেছে। এছাড়া প্রায় শতাধিক ব্যক্তিকে নানাভাবে প্রতারিত করার বিষয়ে জানা যায়।
গ্রেপ্তারকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র্যাব জানায়, ভুয়া আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপণ, ভূয়া কোম্পানি ওয়েবসাইট, বিদেশে ভূয়া সাজানো ফ্যাক্টরী এবং অফিস পরিদর্শন, সাজানো বিপনন কেন্দ্র এবং ভুয়া কৃষি খামার ইত্যাদিতে আকৃষ্ট হয়ে জিয়া উদ্দিনকে সরলভাবে বিশ্বাস করে ব্যবসায়ীরা তার প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হত। সে বেশ কয়েকটি ব্যাংক থেকে তার নাম সর্বস্ব ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ৩০০ শত কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে তার উল্লেখযোগ্য অংশ মানি লন্ডারিং করে বিদেশে পাচার করেছে বলে জিয়া উদ্দিন। গ্রেপ্তারের প্রতারণার কৌশল সম্পর্কে খন্দকার মঈন জানান, ২০০৯ সালে প্রবাসে থাকা অবস্থায় টাইলস ব্যবসার খুঁটিনাটি সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করে। বিদেশি দুটি দেশের মাফিয়াদের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা এক দেশ হতে অন্য দেশে স্থানান্তর করেন। এতে অর্থ পাচার চক্রের সঙ্গে সখ্য তৈরি হয়। ২০১৪ সাল থেকে ফোসান সিরামিক, হাইটেক সিরামিক লি. এর নামে আমদানির ক্ষেত্রে ২৪ থেকে ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণ করে টাইলস আমদানি দেখাতেন। পরবর্তী সময়ে ওই সমস্ত দেশে ৬ শতাংশ কোম্পানি ও ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ নিজে গ্রহণ করতেন। আর এভাবেই ২০১৬ সাল থেকে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা পাচার করেছেন বলে আমরা তথ্য-প্রমাণ পেয়েছি।
গ্রেপ্তারকে জিজ্ঞাসাবাদে র্যাব আরও জানায়, সে প্রতারণার কৌশল হিসেবে ব্যবসায়ীদের দামি এবং আকর্ষণীয় গিফট প্রদান করত। পরবর্তীতে তাদেরকে বিদেশে তার তথাকথিত ভুয়া মালিকানাধীন টাইলস ফ্যাক্টরিতে ভ্রমণের ব্যবস্থা করত। ঐসব ফ্যাক্টরির অফিসের পরিদর্শনযোগ্য ব্যবস্থাপনার জন্য অর্থ প্রদান করত। সে শিগগিরই বাংলাদেশে এই ধরণের ফ্যাক্টরী স্থাপন করতে যাচ্ছে বলে দেশি/বিদেশি ব্যবসায়ীসহ খ্যাতনামা অনেককেই প্রলুব্ধ করত। কারসাজি হিসাবের মাধ্যমে অস্বাভাবিকভাবে দেশে উৎপাদিত পণ্যের লাভ দেখিয়ে সকলকে বিভ্রান্ত করত
র্যাব মুখপাত্র বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশের সরকারি উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে তার সখ্য রয়েছে বলে প্রচার করতেন। বিভিন্ন প্রজেক্টের নামে কয়েকশ একর জমি লিজ নিয়ে নিজস্ব বলে প্রচার করতেন। টাইলসহ বেশকিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ধারণা দিতে সাময়িক দোকান ভাড়া করে প্রদর্শন করতেন। পরবর্তী সময়ে তিনি দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীদের সেখানে পরিদর্শন করিয়ে বিনিয়োগের নামে অর্থ আত্মসাৎ করতেন।
গ্রেপ্তার আরও জানায়, নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগসাজসের মাধ্যমে টাইলসে ফোসান সিরামিকের লোগো খোদাই করে নিজের ফ্যাক্টরী থেকে তৈরিকৃত বলে প্রচার করে বাংলাদেশে ব্যবসা করে। তাই নিজেকে একজন আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন ব্যবসায়ীর ঠাট বজায় রাখত।
কমান্ডার মঈন বলেন, বিভিন্ন ব্যক্তিদের প্রতারিত করে প্রতারিত অর্থ দিয়ে সে বিলাসী জীবনে খরচ করত। সে ক্রেতাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমান অর্থ নিয়ে যৎসামান্য টাইলস সরবরাহ করত। বাকী অর্থ দিয়ে সে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ জমি ক্রয় বা পাওয়ার অ্যাটর্নি নিয়ে নিত। অতঃপর ঐ সমস্ত জমির বিপরীতে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কয়েকশত কোটি টাকা লোন নেয়। অতঃপর উক্ত অর্থ এবং প্রলুব্ধ লোকজন হতে প্রতারণার মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্ধ কোটি টাকা আন্ডার-অভার ইনভয়েজের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছে বলে জানায়।
জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, ২৪%-২৫% অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণ করে টাইলস আমদানি দেখাত; পরবর্তীতে ঐ সমস্ত দেশে ৬% উক্ত কোম্পানী ও ১৮%-১৯% সে গ্রহণ করত বলে জানায়।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তার তার ৪টি ব্রান্ডের সিরামিকস বা টয়লেট সামগ্রীর ব্যবসার আড়ালে বিভিন্নভাবে মানুষদের প্রতারিত করে। প্রতারণার অর্থ থেকে প্রায় ১৩০ বিঘা জমি কেনে। যার বিপরীতে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় তিনশত কোটি টাকা ব্যাংক লোন নেয়। দেশে বিভিন্ন ব্যাংকে ৩৯টি এ্যাকাউন্ট ও বিদেশে ৩টি ব্যাংকে এ্যাকাউন্ট রয়েছে। এছাড়াও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ৬০-৭০ টি ব্যাংক একাউন্ট রয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় প্রতারণাসহ বিভিন্ন অপরাধে ১৮-২০টি মামলা রয়েছে বলেও জানান র্যাব কর্মকর্তা খন্দকার মঈন।