ক্ষমতাসীন পার্টি কনজারভেটিভ পার্টি নেতা এবং সেই সাথে দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ঋষি সুনাকের নির্বাচন ব্রিটেনের রাজনীতিতে একটি মোড় ঘোরানো ঘটনা। কারণ এই প্রথম ব্রিটেনে একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত অভিবাসীর সন্তান, একজন অশ্বেতাঙ্গ ব্রিটেনের রাষ্ট্র ক্ষমতার শীর্ষ পদে বসছেন।
মাত্র ৪২ বছরের সুনাক হবেন ব্রিটেনের ৫৭তম প্রধানমন্ত্রী, এবং ১৮১২ সালের পর থেকে সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী। দেশটির রাজনীতির ইতিহাসে সাম্প্রতিক সময়ে ২০১০ সালের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের চেয়েও ছোট সুনাক। ২০১০ সালে ক্যামেরন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময় তার বয়স ছিল ৪৩। আর এর আগে ১৮১২ সালে সর্বকনিষ্ঠ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন টোরি দলের রবার্ট জেনকিনসন।
সুনাকের বাবা-মা ভারতীয় বংশোদ্ভূত হলেও তারা থাকতেন পূর্ব আফ্রিকায়, এবং সেখান থেকেই তারা ব্রিটেনে এসে বসবাস শুরু করেন। ঋষি সুনাকের জন্ম ১৯৮০ সালে ইংল্যান্ডের বন্দরনগরী সাদাম্পটনে। তার বাবা সেখানে চিকিৎসক ছিলেন। মা একটি ফার্মেসি চালাতেন । ফলে পরিবার ছিল বেশ সচ্ছল।
নাম করা প্রাইভেট স্কুল উইনচেস্টার কলেজে পড়াশোনা করেছেন তিনি। গ্র্যাজুয়েশন করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরে আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছেন। সেখানেই তার সাথে পরিচয় হয় ভারতীয় ধনকুবের এবং আইটি সেবা কোম্পানি ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তির মেয়ে অক্ষতার সাথে। তারপর প্রেম এবং প্রণয়। দুটো মেয়ে রয়েছে এই দম্পতির।
২০০১ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত সুনাক মার্কিন বিনিয়োগ কোম্পানি গোল্ডম্যান সাক্সে চাকরি করেছেন। পরে দুটো হেজ ফান্ডের অংশীদার ছিলেন।
ঋষি সুনাক ২০১৫ সালে প্রথম উত্তর ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ার কাউন্টির রিচমন্ড এলাকার এমপি হন। ব্রেক্সিট অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনকে বের করে আনার পক্ষে কাজ করেছেন তিনি। ব্রেক্সিট গণভোটের প্রচারণার সময় পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ব্রেক্সিটের পর ব্রিটেন আরও মুক্ত, আরও সমৃদ্ধ দেশ হবে।
সে সময় তিনি শক্ত অভিবাসন নীতির পক্ষে কথা বলেন। তিনি বলেছিলেন, যদিও আমি বিশ্বাস করি যথাযথ অভিবাসন নীতি দেশের জন্য মঙ্গলজনক। কিন্তু সীমান্ত আমাদেরকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
টেরিজা মে’র সরকারে ঋষি সুনাক স্থানীয় সরকার বিভাগে জুনিয়র মন্ত্রী হন। পরে বরিস জনসন ক্ষমতা নেওয়ার পর তাকে পদোন্নতি দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিফ সেক্রেটারি নিয়োগ করেন।
বরিস জনসনের সাথে মনোমালিন্য তৈরি হওয়ায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে পদত্যাগ করলে অর্থমন্ত্রী হন ঋষি সুনাক। কিন্তু ২০২২ সালে কোভিড লকডাউন ভেঙ্গে পার্টি করা এবং তা নিয়ে মিথ্যা বলার অভিযোগে প্রচণ্ড চাপে বরিস জনসন যখন হিমশিম খাচ্ছিলেন, তখন অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন সুনাক।
অনেকে মনে করেন, তার পদত্যাগের মধ্য দিয়েই বরিস জনসনের পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল। বরিস সমর্থকরা তার বিরুদ্ধে সুযোগ-সন্ধানীর অভিযোগ আনলেও সুনাক বলেছিলেন, নৈতিক কারণে সে সময়ে তিনি সরে গিয়েছিলেন।
বরিস জনসনের পদত্যাগের পরপরই নেতৃত্বের নির্বাচনে প্রার্থী হন ঋষি সুনাক। প্রচারণায় তিনি নিজেকে চৌকস একজন আর্থিক ব্যবস্থাপক হিসাবে তুলে ধরেন। তার প্রচারণার প্রধান বার্তা ছিল – কোভিড এবং ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে ব্রিটিশ অর্থনীতি ভীষণ সংকটে এবং তার প্রধান কাজ হবে এর সমাধান করা।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেপ্টেম্বর মাসে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচনের ভোটে তিনি লিজ ট্রাসের কাছে হেরে যান। তার সরকারের দেয়া অন্তর্বর্তীকালীন বাজেটে আর্থিক খাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ায় দলের ভেতর প্রচণ্ড চাপে পড়ে গত সপ্তাহে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস। এর পরপরই আবারও নেতৃত্বের ব্যাপার তার প্রার্থিতা ঘোষণা করেন ঋষি সুনাক। এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলের নেতা নির্বাচিত হয়ে যান।
সূত্র:বিবিসি