মো. আহসানুল ইসলাম আমিন :
একটি দেশের স্বাধীন সার্বভৌমত্বের প্রতীক হচ্ছে তার পতাকা। আর এ পতাকা একটি দেশ তথা রাষ্ট্রের পরিচয় বহন করে। তেমনি আমাদের দেশের পরাধীনতার আবরণ থেকে বের হয়ে স্বাধীনতার সোনালি অক্ষরে নাম লিখানোর একটি অর্জন হচ্ছে এ সবুজের বুকে লাল পতাকা। কাতার ফুটবল বিশ্বকাপকে মুন্সিগঞ্জ জেলার সর্বত্র এখন প্রিয় দলের সমর্থনে সেই দেশের পতাকা নিজের বাড়িতে লাগানোর হিড়িক পরে গেছে। কে কার চেয়ে বড় পতাকা বানাতে ও উড়াতে পারে তা নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে। এ প্রতিযোগিতায় গা ভাসিয়ে অনেকে ভুলেই গেছে পতাকার মাপ, উড়ানোর নিয়ম ও সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে। জেলার সচেতন নাগরিকদের অভিযোগ, ফ্লাগ রুলস বা পতাকা আইনের বিষয়ে জানা নেই অধিকাংশ মানুষের। বিধি না মেনে পতাকা টানানো হলে শাস্তির বিধান আছে সেটাও জানেনা অনেকে। যার কারণে ফুলবল প্রেমী মানুষগুলো ভিন দেশী পতাকা বাড়ীতে টানানোর পাশাপাশি নিজ দেশের পতাকাকে নানাভাবে অবমাননা করছেন। যেখানে একই বাঁশ বা লাঠিতে একাধিক পতাকা উড়তে থাকে। প্রায় সময়ে পতাকা একবার উত্তোলন করলে আর নামান না। অথচ নিয়ম বলছে, সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে পতাকা নামাতে হবে। কেউ আবার দেশপ্রেমে মত্ত হয়ে লাঠির মাথায় ছোট্ট করে বাংলাদেশের পতাকা তার নিচে সমর্থিত দলের বড় পতাকা লাগিয়ে থাকেন। পতাকা বিধি সম্পর্কে মানুষ জানার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করছেন না। যারা জানেন তারাও কোন কোন ক্ষেত্রে তা সঠিকভাবে পালন করছেনা। জেলাজুড়ে জাতীয় পতাকার অবমাননা বন্ধে এখনই কার্যকরি ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন জেলার সচেতন নাগরিকরা।
সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পাড়া মহল্লার বাড়ী ঘরের ছাদে, গাছের ঢালে, রাস্তার পাশে এবং বিভিন্ন স্থাপনায় টানানো হয়েছে বিভিন্ন দেশের পতাকা। অধিকাংশ পতাকা উত্তোলনকারী ফুলবল সমর্থকরা একই খুঁটির উপর একাধিক পতাকা টানিয়ে রেখেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার সাথে অন্য পতাকা এই খুঁটিতে উড়ানোর নিয়ম নেই সেটাও তারা মানছেনা। ভিনদেশী পতাকার উপরে ছোট্র করে অনেকে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে রেখেছেন। যত্রতত্র জাতীয় পতাকা ব্যবহার ও অবমাননার চিত্র লক্ষ্য করা গেছে জেলার সর্বত্র। অনেকে মনে করছেন দেশ প্রেমের কারণে তারা জাতীয় পতাকাতো টানিয়েছেন। কিন্তু ফ্লাগ রুলস না মেনে পতাকা টানানো অপরাধ এবং এর কারণে শাস্তির বিধান রয়েছে এটাও জানা নেই তাদের। পতাকার নির্দিষ্ট মাপ আছে। কখন কোথায় কোন মাপের পতাকা উড়ানো যাবে, তার নিয়মও আছে। কিন্তু সেই নিয়ম না মেনে পতাকা উড়ানো মানেই জাতীয় পতাকাকে অবমাননা করা। বিশেষ দিবসগুলো যেমন,২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসসহ সরকারি প্রজ্ঞাপনে উল্লেখিত অন্যান্য দিবসগুলোকে বাংলাদেশের সর্বত্র সরকারি-বেসরকারি ভবনগুলো ও অফিসগুলোতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের জন্য নির্দেশনা থাকে। কিন্তু তখন মানুষ এভাবে পতাকা টানান না কেন ? এমন প্রশ্ন এখন বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ মুখে ।
জাতীয় পতাকার সঠিক ব্যবহার ও অবমাননার বিষয়ে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে জানান,বাংলাদেশের পতাকার ওপরে অন্য কোনো দেশের পতাকা বা অন্য কোনো রঙিন পতাকা উত্তোলন করা যাবে না এটা আইনে থাকলেও সেটা মানছেনা অনেকে। বিশ্বকাপ ফুটবল খেলাকে ঘিরে জেলায় বাংলাদেশের ফ্লাগ রুলস বা পতাকা আইন অমান্য করা হচ্ছে। জেলাজুড়ে বিভিন্ন দলের বাংলাদেশি সমর্থকরা বিভিন্ন স্থানে বিদেশি পতাকা উত্তোলন করেছেন। আবেগের বসে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে গিয়ে অনেক কষ্টে অর্জিত এ পতাকার চরম অবমূল্যায়ন করছেন। বহু কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত নিজ দেশের পতাকা অবমননা করছেন কিছু মানুষ। তাদের মনে যদি দেশ প্রেম থাকতো তারা কখনও ভিনদেশী পতাকাকে প্রধান্য দিতোনা। নিজ দেশের পতাকাকেও অবমাননা করিত না। বিভিন্ন সরকারী ও জাতীয় দিবসগুলোতে পতাকা উড়ানোর কথা থাকলেও মানুষ তখন সেটা সঠিকভাবে পালন করেনা। অথচ বিশ্বকাপ আসলেই ভিনদেশী পতাকা নিয়ে মাতামাতি আর নিজ দেশের জাতীয় পতাকার মান ক্ষুন্ন করেন অনেকে। প্রতিটি নাগরিকের উচিৎ জাতীয় পতাকার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা। জাতীয় পতাকা টানানোর বিধিগুলো সম্পর্কে সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে সচেতন করতে প্রশাসনকে কার্যকরি উদ্যোগ নিতে হবে। পতাকা আইনে যে, শাস্তির বিধান রয়েছে সেটা যথাযথভাবে প্রয়োগ করলে জাতীয় পতাকার মান রক্ষার পাশাপাশি মানুষ সঠিকভাবে জাতীয় পতাকা টানানোর বিষয়টি মানুষ গুরুত্ব দিবে বলেও জানান বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ।
ফ্ল্যাগ রুলস’-এর ৪ ও ৭ বিধি বলছে, কিছু নিয়ম ও সুনির্দিষ্ট ছাড়া বেসরকারি জনসাধারণ কর্তৃক জাতীয় পতাকার যত্রতত্র ব্যাবহার নিষিদ্ধ। জাতীয় পতাকার প্রতি অবমাননা প্রদর্শন করা বা জাতীয় পতাকার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন না করলে ওই ব্যক্তিকে ২০১০ সালের ২০ জুলাই প্রণীত আইন অনুযায়ী ৫ হাজার টাকা জরিমানা বা এক বছরের কারাদণ্ড কিংবা উভয়দণ্ডের বিধান রয়েছে।
সরকারী হরগঙ্গা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আব্দুল হাই তালুকদার বলেন, জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং নামানোর নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম কানুন রয়েছে। কিন্তু আমরা বিশেষ বিশেষ সময়ে লক্ষ করি যে,আমাদের দেশে জাতীয় পতাকা উঠানো ও নামানোর নিয়মাবলী সেগুলো যথাযথভাবে মেনে চলা হয় না। বিশেষ করে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা শুরু হয় তখন আমাদের দেশে বিভিন্ন দেশের জাতীয় উত্তোলনের হিড়িক পড়ে যায়। তখন আমাদের জাতীয় পতাকা সেখানে থাকেনা বা কোন কোন জায়গায় থাকলেও ছোট্র একটি পতাকা এবং বিরাট বড় একটি অন্য দেশের পতাকা লাগানো হয়ে থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে আমাদের দেশের পতাকা টানানোই হয়না। যারা যে দলকে সমর্থন করে তারা সেই দেশের জাতীয় পতাকা টানিয়ে থাকেন। এই পতাকা টানাতে গিয়ে অনেকে এক্সিডেন্ট হচ্ছে, আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত ও সংশ্লিষ্টতাও এর মধ্যে রয়েছে। পতাকা উত্তোলনের যে বিধিমালা আছে এটা অনেকেই জানেনা। এই বিষয়গুলো আমাদের যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জানান দেয়ার প্রয়োজন যে, যেকোনভাবেই অন্য দেশের পতাকা উড়ানো যাবে কি না ?। আমাদের দেশের পতাকা সেখানে কিভাবে উত্তোলন করতে হবে এবং কিভাবে নামাতে হবে। দীর্ঘ ১ মাস এই বিশ্বকাপ খেলা চলবে। খেলাপ্রেমী মানুষ এই খেলাপ্রেমের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে জাতীয় পতাকার মান ও মর্যাদাকে যেন ক্ষুন্ন না করি। তিনি আরো বলেন,আমাদের শিক্ষক, আমাদের ছাত্র এবং সাধারণ মানুষের কাছে অনুরোধ এটাই তারা যেন জাতীয় পতাকাকে কোনভাবে অবমাননা না করেন। অন্য দেশের পতকা আমাদের স্বাধীন দেশে প্রধান্য যেন না দেয়া হয় সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষ এ বিষয়ে যেন একটি মনিটরিং ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। পতাকা উত্তোলনের বিষয়ে যে আইন রয়েছে সেটাতে পতাকার অবমাননার শাস্তির বিধান রয়েছে। সেই আইনের বিধান যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে কিনা সেটাও ভেবে দেখার সময় চলে আসছে।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শীলু রায় বলেন, এটা বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে নতুন করে কোন ওইরকম ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তারপরও উপজেলা নির্বাহী অফিসারদেরকে বলবো তারা যেন এই বিষয়টা দেখেন। পতাকা বিধি যদি কোথাও লঙ্ঘন করা হয় তাহলে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তারা আইনগত ব্যবস্থা নিবেন। আমি তাদেরকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশনা দিচ্ছি । উপজেলা প্রশাসনের যারা দায়িত্বে আছেন তারা এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিবেন।