পবিত্র রমজানুল মোবারককে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম দশ দিন রহমতের, দ্বিতীয় দশক মাগফিরাতের আর তৃতীয় দশক নাজাতের। আজ রামাদানের দশম দিন, রহমতের শেষ দিন। এ মৌসুমের মতো শুরু হল রহমতের দশক। রামাদানের বিশেষ ইবাদতে মুমিন বান্দা আল্লাহর রহমতে সিক্ত হয়ে মাগফিরাত অর্জন করে, জাহান্নাম থেকে মুক্তির সনদ লাভ করে।
হজরত উম্মে সালমা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.) প্রথম বছর রামাদান প্রথম দশকে ইতেকাফ করেন, অতঃপর মধ্যম দশকে, এরপর শেষ দশকেও ইতেকাফ করেন। তিনি (সা.) প্রথম দশকেও নফল ইতেকাফ করেছেন একান্তই আল্লাহর রহমত পাওয়ার আশায়। মনে রাখা চাই, মুমিন বান্দা যদি ইবাদতমুখী জীবন গঠন করতে পারে তাহলেই রহমত লাভে ধন্য হতে পারে। এক্ষেত্রে বলা যায়, আমাদের প্রিয় নবী মোহাম্মদ (সা.) চাইতেন, কোনো মুমিন যেন রমজানের আমল থেকে বঞ্চিত না হন। নিজেকে অবশ্যই যেন ক্ষমা করিয়ে নিতে পারে। তাছাড়া এ সুযোগ থেকে যে বান্দা বঞ্চিত হবে তাকে তিরস্কারও করা হয়েছে।
হজরত কাব ইবন উজরা (রা.) বর্ণনা করেন, একবার নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, তোমরা মিম্বারের নিকটবর্তী হও। আমরা হাজির হলাম। অতঃপর রসুলুল্লাহ (সা.) মিম্বারের প্রথম সিঁড়িতে পা মোবারক রাখলেন এবং বললেন, ‘আমিন।’ এরপর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখার সময়ও ‘আমিন’ বললেন। খুতবা শেষে মিম্বার থেকে নেমে এলে আমরা জানতে চাইলাম, হে আল্লাহর রসুল! আজ মিম্বারে ওঠার সময় যা শুনলাম, আগে কখনো তা শুনিনি। নবীজি (সা.) বললেন, জিবরাইল (আ.) এসেছিলেন। আমি যখন প্রথম সিঁড়িতে পা রাখি তখন জিবরাইল (আ.) বললেন, ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি, যে রামাদান পেল অথচ তার মাগফিরাত হলো না। আমি বললাম, ‘আমিন।’ দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখার সময় জিবরাইল (আ.) বললেন, ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি, যার সামনে আপনার নাম নেওয়া সত্ত্বেও সে আপনার প্রতি দরুদ শরিফ পাঠ করল না। আমি বললাম, ‘আমিন।’ এরপর তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখতেই জিবরাইল (আ.) বললেন, ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি, যার সামনে তার পিতা-মাতা বা তাদের কেউ বার্ধক্যে পৌঁছেছে অথচ তারা তাকে জান্নাতে পৌঁছাতে পারল না (খিদমত করে জান্নাত হাসিল করতে পারল না)। এর জবাবে আমি বললাম, ‘আমিন।’
চোখের পলকেই যেন শেষ হয়ে গেল রহমতের দিনগুলো। রমজানের পবিত্র সময়ে নিজেকে পবিত্র করার সুযোগ থেকে আমরা কেউই বঞ্চিত হতে চাই না। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, রামাদানের প্রথম দশ দিনে আমরা নিজেকে কতটা রহমতস্নাত করতে পেরেছি? কিছুটা দুর্বলতা বা ঘাটতি হয়তো ছিল! তবে পরের দশকের মাগফিরাত আর নাজাতের সময়গুলো অতি গুরুত্ব দিয়ে নিজেকে ইবাদত এবং আমলে ডুবিয়ে রাখতে হবে।
রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন যে, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন: ‘প্রত্যেক নেক কাজের সওয়াব দশ হতে সাত শত গুণ পর্যন্ত প্রদান করে থাকেন। কিন্তু রোজা কেবল আমারই উদ্দেশ্যে রাখা হয় বলে এর প্রতিদান আমি স্বয়ং দিব।’
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেছেন, ‘যারা রিপুগুলোকে দমন করে খাঁটি পথে অটল থাকবে, তাদেরকে অগণিত সওয়াব প্রদান করা হবে।’ (সূরা যুমার ১০)
রাসূল (সা.) আরও বলেছেন, ‘ছবর ঈমানের অর্ধেক আর ছবরের অর্ধেক রোযা। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন : রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আমার কাছে মৃগনাভীর সুগন্ধ অপেক্ষা অধিক প্রিয়। আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন : ‘আমার বান্দা কেবল আমার সন্তুষ্টির জন্যই পানাহার এবং স্ত্রী সহবাস বর্জন করেছে। আমি স্বয়ং এর বিনিময় বা সওয়াব প্রদান করব।’
রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘রোজাদারের নিদ্রা ইবাদতের তুল্য আর প্রত্যেকটি শ্বাস-প্রশ্বাস তাসবীহ পাঠের তুল্য এবং প্রার্থনা নির্ঘাত কবুলযোগ্য।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘পবিত্র রামাদান মাস আসার সঙ্গে সঙ্গে বেহেশতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। শয়তানকে তার দলবলসহ বন্দী করা হয়। তখন ঘোষণা করা হয় : ‘হে কল্যাণকামী! শীঘ্র আস, এখন তোমাদের সময় অর্থাৎ কল্যাণ গ্রহণে দ্রুত অগ্রসর হও। ইহা তোমাদের জন্য সুসময়। আর হে পাপী, থাম- এখানে তোমার স্থান নয়। অর্থাৎ তোমাদের পাপের পথ রুদ্ধ হয়েছে।’ আর রোজার গৌরব ও মর্যাদা এই যে, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রোজাকে নিজের দিকে ইশারা করে বলেছেন : রোজা আমারই উদ্দেশ্যে রাখা হয় এবং আমি উহার পুরস্কার প্রদান করবো।’
রাসূল (সা.) আরও বলেছেন, ‘রোজা ঢালস্বরূপ।’ উম্মুল মোমেনিন হযরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, ‘তোমরা জান্নাতের কপাটে খটখটি দাও।’ আরজ করা হল : কেমন করে, তিনি বললেন, ‘ক্ষুধার দ্বারা’। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘রোজা অন্য সব ইবাদতের প্রবেশদ্বার।’
রহমতের দশক শেষ হওয়ার আগে রোজাদারের করণীয়
রামাদানের রহমতের দশক শুরু।রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘রামাদানের প্রথম দশক রহমতের, মধ্য দশক মাগফেরাতের আর শেষ দশক নাজাতের।’ প্রথম দশকে মহান আল্লাহ বান্দার প্রতি অবিরত রহমত নাজিল করেন। রহমতের দশক প্রায় শেষের পথে। আল্লাহর রহমত পেয়ে কি ধন্য হতে পেরেছে রোজাদার?
রামাদানের প্রথম দশকে আল্লাহ বান্দার উপর স্পেশাল রহমত বর্ষণ করেন। রমজানের প্রথম দশদিন ফুরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু রহমত পাওয়ার পাথেয় কতটুকু অর্জিত হয়েছে! অথচ রমজান মাস হল মুমিনের জীবনে রহমতের বসন্তকাল।
মুমিনের উপর অনবরত রহমত নাজিল হতে থাকে রমজানে। তাই এ মাস রহমতের পাথেয় সঞ্চয়ের মৌসুম ৷ রামাদানে মুমিনদের জন্য যেমন কল্যাণময় মাস, ঠিক বেদ্বীন-মুনাফিকদের জন্য সবচেয়ে ক্ষতির মাসও এই রমজান। রামাদানজুড়ে মুমিনগণ সারা বছরের পাথেয় সংগ্রহে ব্যস্ত থাকে। অপরদিকে মুনাফিকরা থাকে উদাসীন আর দোষত্রুটি অন্বেষণে মগ্ন। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলার কসম! মুসলমানদের জন্য রামাদানের চেয়ে উত্তম কোনো মাস আসেনি এবং মুনাফিকদের জন্য রমজান মাসের চেয়ে অধিক ক্ষতির মাসও আর আসেনি। কেননা মুমিনগণ এ মাসে ইবাদতের শক্তি ও পাথেয় সংগ্রহ করে। আর মুনাফিকরা তাতে মানুষের উদাসীনতা ও দোষত্রুটি অন্বেষণ করে। এ মাস মুমিনের জন্য গনীমত আর মুনাফিকের জন্য ক্ষতির কারণ।’ (মুসনাদে আহমাদ)
সুতরাং রামাদান মাসের রহমতের দশকের শেষ দিকে এসে সবাইকে এ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে, ‘মুনাফিকের মতো সারা জীবন মানুষের দোষত্রুটি অন্বেষণে মগ্ন না থেকে রহমত বরকত মাগফেরাতের মাস রমজানে বেশি বেশি নেক আমল করে অন্য মাসগুলোর জন্য পাথেয় অর্জন করা।
রহমতের মাস রামাদান সর্ম্পকে মহান আল্লাহর ঘোষণাও ছিল বেশি বেশি নেক কাজে নিয়োজিত থাকার সুযোগ নিশ্চিতের আহ্বান। হাদিসে এসেছে-
‘ রামাদান জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং অভিশপ্ত শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা হয়।’ (বুখারি)
জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়ার অর্থই হলো- নেক আমল করা সহজ হয়ে যাওয়া আর জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়ার অর্থই হলো- বদ আমলের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া। আর শয়তানকে শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলার অর্থই হলো- রামাদানের আগে তারা স্বাধীনভাবে যথেচ্ছা বিচরণ করেছে এবং বান্দাকে কুমন্ত্রণা ও প্ররোচনা দিয়ে যে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে; রামাদানের প্রথম রাতেই তাদের বন্দী করা হয়, যেন রোজাদারকে ধোঁকা ও প্রতারণা দিয়ে বিভ্রান্ত করতে না পারে।
রহমতের মাস রামাদানজুড়ে পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা এবং নেক কাজে নিয়োজিত থাকা অনেক সহজ। তাই রামাদানের রহমতের দশকে আল্লাহর অনুগ্রহ পেতে রোজাদারের করণীয় হলো-
– দিনের বেলা একনিষ্ঠতার সঙ্গে রোজা পালন করা।
– যথা সময়ে জামআতে নামাজ আদায় করা।
– রাতের তারাবিহ ও তাহাজ্জুদ আদায় করা।
– বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করা।
– দান–সদকা করা।
– ফেতরা ও জাকাত দেয়া।
– আল্লাহর জিকিরে মশগুল হয়ে তাকওয়া অর্জনে অধিক সচেষ্ট হওয়া।
রমজনের বিশেষ রহমত বা অনুগ্রহ পাওয়ার ঘোষণা-
– ‘যে ব্যক্তি বিশ্বাসের সঙ্গে সাওয়াব বা প্রতিদান পাওয়ার নিয়তে রামাদান মাসে রোজা রাখবে, তার বিগত জীবনের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’
– ‘যে ব্যক্তি বিশ্বাসের সঙ্গে সাওয়াব বা প্রতিদান পাওয়ার নিয়তে রামাদান মাসে তারাবিহ নামাজ পড়বে, তার বিগত জীবনের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’
– ‘যে ব্যক্তি বিশ্বাসের সঙ্গে সাওয়াব বা প্রতিদান পাওয়ার নিয়তে রামাদান মাসে লাইলাতুল কদরে (রাত জেগে) ইবাদত করবে, তার বিগত জীবনের সব গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
– হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সব মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় দানশীল। রামাদানে জিবরিল আলাইহিস সালাম যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতেন, তখন তিনি আরও অধিক দান করতেন। রামাদান শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতেই জিবরিল আলাইহিস সালাম তাঁর সঙ্গে একবার সাক্ষাত করতেন। তিনি (বিশ্বনবি) তাঁকে কুরআন শোনাতেন। জিবরিল যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতেন তখন তিনি প্রবাহিত বায়ু অপেক্ষা অধিক ধন-সম্পদ দান করতেন।’ (বুখারি)
রামাদানের রহমতের দশকে মহান আল্লাহর রহমত বা অনুগ্রহ পেলেই রোজাদারের রোজা ও ইবাদত সফল এবং স্বার্থক। তবেই সে বিপদ-আপদ ও বালা–মুসিবত থেকে রক্ষা পাবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি পাবে। নতুবা সে হবে মহান আল্লাহর রহমত তথা অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত।
সুতরাং প্রত্যেক রোজাদারের উচিত, আল্লাহর রহমত পাওয়ার জন্য পুণ্যের কাজে এগিয়ে যাওয়া। আল্লাহ তাআলার দয়া-মায়া সংক্রান্ত গুণবচক নামগুলো বেশি বেশি স্মরণ করা এবং উক্ত গুণাবলী নিজেদের মধ্যে অর্জন করার চেষ্ট করা। আচরণে সর্বোচ্চ দয়া প্রদর্শন করা। ঠিক হাদিসের এ ঘোষণার মতো-
‘তুমি দুনিয়াবাসীর ওপর দয়া করো; তবে আল্লাহ তোমার প্রতি দয়া করবেন।’ অর্থাৎ যে মানুষর প্রতি দয়া করে না মহান আল্লাহও তার প্রতি দয়া করেন না।’ (তিরমিজি)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রহমতের দশকে বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগি ও মানুষর সহনুভূতিশীল হওয়ার তাওফিক দান করুন। রোজার হকগুলো যথাযথভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। রহমতের দশকে মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ পাওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
মাওলানা মুহাম্মদ রাহাত উল্লাহ
লেখক, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক
সহকারী শিক্ষক
উত্তর রাঙ্গুনিয়া উচ্চ বিদ্যালয়,
রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।
rumamun1986@gmail.com.