সেই সুখরঞ্জন বালিকে আবার পাওয়া গেলো যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধী অপরাধে দন্ডিত দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর জানাজায়। এই সময় তিনি সাঈদী ফাউন্ডেশনে হাজির হন এবং জামায়াত সমর্থিত বিভিন্ন ইউটিউবারদের ইন্টারভিউ দিয়েছেন। এতে বোঝা যাচ্ছে, এই দীর্ঘ সময়ে সুখরঞ্জন বালি জামায়াতিদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করেই দিনানিপাত করেছেন।
সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক মীমাংসিত ইস্যুকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সুখরঞ্জন বালি নামক এক ব্যক্তিকে লালন পালন করে ব্যবহার করা হলো। জাতির সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করা হলো যেন এই মামলা একমাত্র সাক্ষি সুখরঞ্জন বালি!
সাঈদীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের পক্ষে জবানবন্দি গ্রহণ করা হয় ১৩২ জনের। সেখান থেকে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয় ৬৮ জনকে। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে দায়ের করা রাষ্ট্রপক্ষের মামলার চূড়ান্ত সাক্ষী হলেন ৮ জন।
যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর বিরুদ্ধে দেয়া সাক্ষীরা নানা সময়ে হেনস্তার শিকার হয়েছেন।
সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের বিভিন্নভাবে হেনস্তা ও নির্যাতন করেছে জামায়াত।
রাষ্ট্রপক্ষের ৮ নম্বর সাক্ষী মোস্তফাকে সিঁদ কেটে ঘরে ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। বিষয়টাকে সিঁধল চুরির মতো করে সাজানো হয়। (এই সিঁধল চুরির মতো করে সাজানোর বিষয়টি জঙ্গিদের একটি পরিচিত কৌশল। আমরা স্মরণ করতে পারি যে প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলকে কুপিয়ে হত্যা করার চেষ্টার মাত্র কয়েক দিন আগে তার বাসভবনের ঠিক নিচের ফ্ল্যাটে এরকম রহস্যজনক চোরেরা বারান্দার গ্রিল কেটে ঢুকেছিল এবং কিছুই চুরি করেনি। মনে করা হয় তারা ফ্ল্যাট চিনতে ভুল করেছিল।)
২০১৩ সালের অক্টোবরে, প্রধান সাক্ষী মাহাবুবুর রহমানের প্রাণনাশের জন্য বাড়িতে জামায়াত শিবির হামলা চালালে তিনি সৌভাগ্যবশত প্রাণে রক্ষা পান।
২০২১ সালে ৭২ বছর বয়সী বৃদ্ধ সাক্ষী জলিল শেখকে তাঁর দোকানে হামলা করে একজন অপরিচিত ব্যক্তি। জলিল শেখ গুরুতর আহত হলেও তার আশপাশে পুলিশি পাহারা থাকায় দ্রুত উদ্ধার হয়ে প্রাণে বেঁচে যান।
এই গেলো হামলা ও নির্যাতনের চিত্র। সাক্ষীদের লোভ দেখিয়েও ভারতে চলে যাওয়ার উপদেশ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ১৩ জুন ২০১৭ সালে প্রথম আলোতে সাক্ষী গৌরাঙ্গ সাহা বলেন, ‘সাক্ষ্য না দিতে সাঈদীর ছেলে এক ব্যাগ নিয়া আইছিল। বলছিল, “ভারত চলে যাও।” যাইনি।
সুখরঞ্জন বালি রাষ্ট্রপক্ষের কাছে জবানবন্দি দেওয়ার পরপরই নিখোঁজ হয়ে যান বলে তার মেয়ে মনিকা রাণী মণ্ডল গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২ সালে থানায় জিডি করেন। এই সময় জামায়াতের আইনজীবীরা বলতে শুরু করেন, রাষ্ট্রপক্ষ ইচ্ছা করে সুখরঞ্জন বালিকে হাজির করছে না। যদিও প্রসিকিউশন পক্ষ আদালতকে বলেন, যেহেতু বাদবাকি সাক্ষী হাজির হয়েছেন, সুখরঞ্জন বালি অনুপস্থিত থাকায় তাঁর জবানবন্দিকে আদালত বিবেচনা করতে পারেন। ইনফ্যাক্ট এই সময় পর্যন্ত সুখরঞ্জন বালি এককভাবে আলাদা গুরুত্ব পাননি। সাঈদীর পক্ষে ও বিপক্ষে সব ধরনের সাক্ষীর সাক্ষ্য শেষ হয়েছে ২৩ অক্টোবর। তারপর হুট করে ৫ নভেম্বর সুখরঞ্জন বালি জামায়াতের আইনজীবীদের গাড়িতে করে এসে আদালতে প্রাঙ্গণে হাজির হলেন। ‘হুট করে’ বলছি, কারণ মামলার শুধু যুক্তিতর্ক পেশ বাকি, সব সাক্ষীর সাক্ষ্যপর্ব শেষ, সেই সময় রাষ্ট্রপক্ষ কিংবা সাঈদী পক্ষ, কেউই সুখরঞ্জন বালির নাম নতুন করে কোনও সাক্ষ্য তালিকায় তোলেননি। সুতরাং তাঁকে আদালত প্রাঙ্গণে হাজিরই করা হয় নাটক করার জন্য। তারপর আরেকটি গাড়িতে টানাহেঁচড়া করে তাঁকে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। জামায়াতের আইনজীবীরা বলতে শুরু করেন, ‘এই অপহরণ সরকারের গোয়েন্দা সংস্থারা করেছে।’
সুখরঞ্জন বালির তারপর খোঁজ পাওয়া যায় ভারতে। সেখানে তিনি অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে গ্রেফতার হয়েছেন। অবৈধভাবে ভারতে ঢোকার দায়ে উত্তর চব্বিশ পরগণার স্বরূপনগর এলাকায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ২৩ ডিসেম্বর রাতে তাকে আটক করে বিএসএফ। জিজ্ঞাসাবাদের জবাবে সুখরঞ্জন বালি বিএসএফের কাছে স্বীকার করেন, তিনি বনগাঁয় তার বড় ভাই পরিতোষ বালির বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশে বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। (সূত্র: বিবিসি, ১৬ মে, ২০১৩)।
গ্রেফতার হওয়ার পর তিনি ভারত সরকারের কাছে ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ প্রার্থনা করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভারতের ‘নিরাপদ পরিবেশে’ তিনি ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ আবেদন করার সময় তিনি বলেন, বাংলাদেশে ফিরলে সরকার তার জীবন সংশয় করতে পারে। কিন্তু সেই আবেদনে তিনি ঘুণাক্ষরেও বলেননি সরকার ইতোমধ্যে তাকে বিপদগ্রস্ত করে ঠেলে ভারতে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তার মামলা ভারতের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়, কিন্তু কোনও ধাপেই তিনি এরকম কিছু বলেননি। জাস্ট বলেছেন, ফিরলে বিপদ হতে পারে। এই কথার কোনও ভিত্তি না থাকায় সুখরঞ্জন বালির আবেদন ভারতের আদালত গ্রাহ্য করেনি এবং তাকে কয়েক মাস পরে আবার বাংলাদেশে ফিরে আসতে হয়। বাংলাদেশে ফেরার পর তাকে কোনও হয়রানি করা হয়েছে বলে অভিযোগও পাওয়া যায় না।
লেখক: হাসান আহমেদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক