শহিদুল ইসলাম, সহ-সম্পাদক: কুষ্টিয়ার কুমড়ো বড়ি বিক্রেতা ও তরুণ উদ্যোক্তা বেলা বলেন, ‘আমরা বাড়িতে কুমড়ো আর কলাই সংগ্রহ করে গ্রামের চার পাঁচজন গৃহবধু মিলে বড়ি তৈরি প্রক্রিয়া শেষ করে বাজারে বিক্রি করি। বড়ি তৈরি করতে পরিশ্রম বেশি হলেও লাভও হয় বেশি। আগে সব সময় কলাই পাওয়া গেলেও কুমড়া পাওয়া যেত না। কিন্তু এখন বড়ি দেয়ার জন্য কুমড়াও পাওয়া যায় সব সময়। তাছাড়া আগের তুলনায় বড়ি তৈরিতে পরিশ্রম অনেক কম। এখন কলাই কুমড়ো মেশিনের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। যেখানে আগে ঢেকিতে পাড় দেয়া লাগতো। তাতে অনেক শ্রম ও সময় লাগতো।’
কুমড়োর বড়ি দেয়ার ধুম পড়েছে গ্রামীণ জনপদে। কৃষি নির্ভর সাতক্ষীরাও এর ব্যতিক্রমি নয়। খেতে সুস্বাদু আর পুষ্টিগুনে ভরপুর জনপ্রিয় খাবার কুমড়োর বড়ি। শীতের মৌসুমে কুমড়ার বড়ির কদরটা একটু বেশি।
বাড়ির আঙিনা, আশেপাশে মাচা করে সেখানে শুকানো হচ্ছে সেগুলো বড়ি। স্বাদে ও মান ভালো হওয়ায় দিন দিন বেড়েই চলেছে বড়ির চাহিদা। বাড়তি আয়ের পথ তৈরি হওয়ায় অন্যান্য কাজের পাশাপাশি পাড়া মহল্লায় নারীরা পালাক্রমে এই বড়ি দেয়ার কাজটি করছেন। অন্যদিকে ভোজন রসিকরাও তা খেয়ে তুলছেন তৃপ্তির ঢেকুর।
মেহেরপুরের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, সারি সারি কুমড়ার বড়ি তৈরি করে রোদে শুকাতে দেয়া হয়েছে। নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও এ কাজে হাত লাগিয়েছেন। সাধারণত শীতকালেই কুমড়া বড়ির চাহিদা বেড়ে যায়। আগে সনাতন পদ্ধতিতে বড়ি তৈরি করা হত। তখন সন্ধ্যায় ডাল ভিজিয়ে রেখে পরের দিন শিলপাটায় বেটে বড়ি তৈরি করা হত। কিন্তু আধুনিকতার ছোয়ায় এখন মেশিনের মাধ্যমে কুমড়ার বড়ি তৈরির ডাল ফিনিশিং করা হয়। হাটবাজারে কুমড়ার বড়ি বর্তমানে খুচরা ৪৫০-৫৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
কয়েকজন গৃহবধুর সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, রাতে কুটা কলাই-কুমড়ার মণ্ড পাত্র করে সারারাত শীতের শিশিরে রাখা হয়। পরের দিন ভোরে গৃহিণীরা একত্রিত হয়ে বসে যান বড়ি দেয়ার কাজে। কাঠ, নেট বা বাঁশের মাচার ওপর পরিষ্কার কাপড় বিছিয়ে তার ওপর ধীরে ধীরে ডান হাতের মুঠোয় বসানো হয় বড়ি। হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় তারা বিশেষ কৌশলে বড়ি তৈরী করেন। এরপর কাঁচাবড়ি শীতের রোদে শুকানো হয়। বড়িগুলো যেন দেখা যায় তারার মতো ফুটে আছে। পরিষ্কার আবহাওয়া ও তীব্র শীতে বড়ি বানালে সেই বড়ি স্বাদযুক্ত হয় বেশি।
বড়ি তৈরী সম্পর্কে গাংনী উপজেলার জোড়পুকুর গ্রামের সাহেদা খাতুন জানান, বাজারে প্রতি কেজি মাস কলাইয়ের ডাল ১০০ থেকে ১২০ টাকা ও চাল-কুমড়ার আকার হিসেবে ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। প্রথমে মাস কলাইয়ের ডাল রোদে ভালো করে শুকিয়ে তারপর পানিতে ৬ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হয়। কুমড়ো থেকে আঁশ ছাড়িয়ে নেয়ার পর এর মধ্যে কিছু মসলা দিয়ে মেশিনের সাহায্যে মিশ্রণ করে কুমড়ো বড়ির জন্য উপকরণ তৈরি করা হয়। আবহাওয়া ভালো হলে কুমড়ো বড়ি গুলো ভালো হয়। বৈরী আবহাওয়া বা শৈত্য প্রবাহের ফলে কুমড়ো বড়ি নষ্ট হয়ে যায়। কুমড়ো বড়ি একটি মুখরোচক খাবার। অনেকের কাছে এটি অনেক প্রিয়। এটির ফলে তরকারির স্বাদে নতুন মাত্রা যোগ হয়।
কুমড়ো বিক্রেতা রশিদ জানান, শীত আসলেই বাজারে চাল কুমড়া ব্যাপক চাহিদা বেড়ে যায়। খুচরা বাজারে প্রতিটি কুমড়া ১০০ থেকে ২৫০ টাকা করে বিক্রি করেন বিক্রেতারা।
কুমড়ো বড়ি বিক্রেতা আশমত বলেন, ‘আমরা বাড়িতে কুমড়ো আর কলাই সংগ্রহ করে গ্রামের চার পাঁচজন গৃহবধু মিলে বড়ি তৈরি প্রক্রিয়া শেষ করে বাজারে বিক্রি করি। বড়ি তৈরি করতে পরিশ্রম বেশি হলেও লাভও হয় বেশি। আগে সব সময় কলাই পাওয়া গেলেও কুমড়া পাওয়া যেত না। কিন্তু এখন বড়ি দেয়ার জন্য কুমড়াও পাওয়া যায় সব সময়। তাছাড়া আগের তুলনায় বড়ি তৈরিতে পরিশ্রম অনেক কম। এখন কলাই কুমড়ো মেশিনের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। যেখানে আগে ঢেকিতে পাড় দেয়া লাগতো। তাতে অনেক শ্রম ও সময় লাগতো।’
স্কুল শিক্ষক জাকির হোসেন বলেন, ‘শীতকালে অনেক সবজি কম দামে পাওয়া যায়। আর সবজির সঙ্গে কুমড়ো বড়ির সম্পর্ক অনেক গভীর।’
প্রবাস ফেরত সালাউদ্দিন বলেন, ‘বিদেশের মাটিতে গেলে দেশের সব কিছুই মিস করি। তবে সবচেয়ে বেশি মিস করি মায়ের হাতে মাছ, আলু দিয়ে বড়ি রান্না। আমি দেশে ছুটিতে এসেছি। এই সময় আসা মানে পিঠা পায়েস আর মায়ের হাতে সবজি রান্না।’
কুমড়োর বড়ির যত পুষ্টিগুণ
পুষ্টিবীদ তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতি ১০০ গ্রাম মাষকলাইতে আছে ৩৪১ মিলিগ্রাম ক্যালরি, ৯৮৩ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম, প্রোটিন ২৫ গ্রাম, সোডিয়াম ৩৮ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম ১৩৮ মিলিগ্রাম আয়রন ৭ দশমিক ৫৭ মিলিগ্রাম। অপরদিকে, চালকুমড়া একটি পুষ্টিকর সবজি। এতে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, মিনারেল ও ফাইবার রয়েছে তাই চাল কুমড়ার উপকারিতা অনেক। যক্ষ্মা, কোষ্ঠকাঠিন্য ও গ্যাস্ট্রিকসহ বহু রোগের উপশম করে চাল কুমড়া। চাল কুমড়া তরকারি হিসেবে খাওয়া ছাড়াও মোরব্বা, হালুয়া, পায়েস এবং পাকা কুমড়া এবং কালাই ডাল মিশিয়ে কুমড়ো বড়ি তৈরী করেও খাওয়া হয়। সব মিলিয়ে কুমড়ো বড়ি নিঃসন্দেহে একটি সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর খাবার।’