স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হতেই সফলতা আসবে কুষ্টিয়ার পরিবহন খাতে। এমন প্রত্যাশায় আছেন কুষ্টিয়ার কোচ সার্ভিস ও পণ্যবাহী ট্রাক কোম্পানির মালিক ও শ্রমিকরা। জেলায় বর্তমানের ১০০ কোটি টাকার সার্বিক বাণিজ্য গিয়ে দাঁড়াবে ৩০০ কোটি টাকায়।
জেলা শহরের ব্যস্ততম এলাকা মজমপুর গেট। প্রতিদিন এখান থেকে ঢাকা-চট্রগ্রাম রুটে প্রায় ২৫টি কোচ সার্ভিস কোম্পানির ২ শতাধিক যাত্রীবাহী বাস এবং ২০টি কোম্পানির ৩০০ পণ্যবাহি ট্রাক যাতায়াত করে থাকে। দূরত্ব, যানজট আর ত্রুটিপুর্ণ সড়কের কারণে প্রতি বছর লভ্যাংশের প্রায় অর্ধেক অর্থ গুণতে হয় এসব খাতে।
মজমপুর গেট বাসস্ট্যান্ড ঢাকাগামী এসবি কোচ সার্ভিস কোম্পানির কাউন্টারের সামনে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন ড্রাইভার রেজাউল ইসলাম। বাড়ি গড়াই নদীর ওপারে হাটশ হরিপুরে। দুপুর ১২টার ট্রিপ নিয়ে তিনি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। পদ্মা সেতু চালু হলে কোন উপকার হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সে জানায়, আরে ভাই যমুনা সেতু হয়ে ঢাকায় যাওয়া আর দিল্লি যাওয়া সমান কথা। মাত্র ২৭৭ কি. মি. রাস্তা যেতে সময় লাগার কথা মাত্র সাড়ে ৪ ঘন্টা থেকে ৫ ঘন্টা। সেখানে এখন সময় লাগে ৮ থেকে ১০ ঘন্টা। তারপর কুষ্টিয়া পার হলে এমন এমন জায়গায় যানজটে পড়তে হয় ফাঁকা মাঠ ভয়ে থাকি কি হয়। নেই কোন দোকান পাট, যাত্রীরা অস্থির হয়ে যায় শিশু-কিশোর নিয়ে। পদ্মা সেতু চালু হলে কুষ্টিয়া থেকে ১ ঘন্টা সময় বেশি লাগবে, দূরত্বও বাড়বে তারপরও তখন অন্তত ২ ঘন্টা আগে কোন প্রকার যানজট ছাড়াই ঢাকা-চট্রগ্রাম পৌছাতে পারবো। ভাড়ার বিষয়ে তিনি জানান, এখন এসি ভাড়া ৮০০ টাকা তখন ১০০ টাকা বেশি হবে আর চেয়ারকোচগুলো ৫৫০ টাকার পরিবর্তে সাড়ে ৬০০ টাকা নেবে ঢাকা পর্যন্ত। অনেক আরামে অনেক কম সময়ে ঢাকা-চট্রগ্রামে পৌছানো যাবে।
সরাসরি কুষ্টিয়া-কক্সবাজারগামী শ্যামলী পরিবহন কাউন্টারের স্বত্বাধিকারী ও বাস-মিনিবাস মালিক গ্রুপের নেতা রেজাউল করিম জানালেন, আমরা অপেক্ষায় আছি পদ্মা সেতু চালুর জন্য। এখন দৌলতদিয়া ফেরি বা যমুনা সেতু হয়ে কক্সবাজার, ঢাকায় আমাদের কোম্পানির গাড়ি যাতায়াত করছে এতে সময় ও দুর্ভোগ দুটোই বেশি। পদ্মা সেতু চালু হলে খুব অল্প সময়ে ঢাকা ও কক্সবাজার পৌছানো যাবে। গাড়ির ডেমারেজও কম হবে যাত্রীরা স্বাচ্ছন্দ বোধ করবেন। তিনি জানান, কুষ্টিয়া থেকে এখন চট্রগাম, কক্সবাজারে শুধু আমাদের কোম্পানি (শ্যামলী পরিবহন) যাতায়াত করে, আমার ধারণা পদ্মা সেতু চালু হলে আরও অনেক কোম্পানি ঢাকা-চট্রগ্রাম-কক্সবাজার, সিলেটগামী কোচ সার্ভিসের সংখ্যা বাড়বে।
কুষ্টিয়া মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক জানান, পদ্মা সেতু চালু হলে আমরা হাফ ছেড়ে বাঁচবো। তিনি জানান, পদ্মা সেতু আমাদের কুষ্টিয়াবাসীর জন্য আর্শিবাদ। এখন যেখানে ১০ ঘন্টায় ঢাকায় যাচ্ছি তখন যাবো মাত্র ৬ থেকে ৭ ঘন্টায়। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক সাশ্রয়ও হবে অনেক। আমরা কুষ্টিয়ার মোটরশ্রমিকরা মনে করি, এখন থেকে বিশেষ করে ঢাকা-সিলেট-চট্রগ্রামে যাবো পদ্মা সেতু হয়ে যমুনা হয়ে নয়। এতে করে দীর্ঘদিনের যানজট, সড়কে নানা সমস্যা এ সব থেকে পরিত্রাণ পাবো। পাশাপাশি পদ্মা সেতু চালু হলে কুষ্টিয়ার পরিবহন খাতেও এখনকার চেয়ে অনেক বেশি অর্থনৈতিক উন্নতি হবে বলে মনে করি।
কুষ্টিয়া বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম হোসেন জানান, পদ্মা সেতু হলে কুষ্টিয়ার অর্থনীতিতে একটা গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা রাখবে। বর্তমানে খুলনা রুটে আমার চারটি বাস রয়েছে। পদ্মা সেতুর জন্য আমি এয়ার এক্সপ্রেস নামে ২টি শুয়ে যাওয়া আধুনিক কোচ সার্ভিস এবং সাধারণ এসি ৪টি বাসসহ ৬টি নতুন কোচ সার্ভিস প্রস্তুত করছি। আশা করছি, ভালো সাড়া পাবো। তিনি বলেন, আমাদের এমপি মাহবুবউল আলম হানিফ এমপি আমাদের বাস ডিপোটিকে বহুতল ভবন নির্মাণসহ আধুনিকায়নে সহযোগীতা করতে চেয়েছেন। পদ্মা সেতু চালু হলে এ রুটে নতুন সার্ভিস চালুর পাশাপাশি আরও নতুন-নতুন কোম্পানি যাতে ঢাকা-চট্রগ্রাম, কুমিল্লা, কক্সবাজার রুটে গাড়ী চালু করে সে বিষয়ে আমরা সাধারণ মালিকদের উৎসাহিত করবো। তিনি আরও জানান, অর্থনীতিতে একটা নতুন গতি আসবে। কুষ্টিয়া থেকে ঢাকা-সিলেট-চট্রগামে প্রায় ৩০০ পণ্যবাহি ট্রাক চলাচল করে।
কথা হয় ইমরান এন্টারপ্রাইজের মালিক পরিবহন ব্যবসায়ী সিহাব উদ্দিনের সাথে, তিনি জানান, সাধারণত কুষ্টিয়া থেকে চাল, কলা, পান, বালি, সবজিসহ বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী দেশের রাজধানী ঢাকা, সিলেট, চটগ্রামে যায়। প্রতি বছর ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয় এ পণ্য সামগ্রী থেকে। পদ্মা সেতু হলে সবজি, পান, চালসহ আরও অনেক পণ্য সামগ্রী কুষ্টিয়া থেকে চটগ্রামে যাবে এবং ট্রাকের ট্রিপও বেড়ে যাবে। তিনি জানান, এখন পান-কলা নিয়ে চট্রগ্রামে একটি ট্রাক ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায় যাতায়াত করে কারণ সড়কে আগে যাত্রীবাহী বাস পরিবহনের গুরুত্ব বেশি। ফেরিতে, ব্রিজে যাত্রীবাহী পরিবহনের গুরুত্ব বেশি পণ্যবাহী ট্রাকের সিরিয়াল সব সময় পড়ে থাকে এ জন্য বাসের যদি একদিন লাগে, ট্রাকের মাল দিয়ে কুষ্টিয়ায় পৌঁছাতে দুই দিন লাগে। ফলে সময় বেশি হওয়ায় খরচও বেশি হয়। তাই প্রতি ট্রিপের ভাড়াও বেশি। এখন পদ্মা সেতু হলে অল্প সময়ে সহজে দেশের যে কোন জেলায় যাতায়াত করা যাবে সড়কে যানজট কম হবে এ জন্য ভাড়াও কম হবে। পণ্য সরবরাহও বৃদ্ধি পাবে। ফলে এখন বছরে ১০০ কোটি টাকার বাণিজ্য গিয়ে দাঁড়াবে ৩০০ কোটি টাকায়, এমন আশা করা যেতেই পারে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।বাসস