গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর দেশ জুড়ে চলছে পালাবদলের হাওয়া। বিশেষ করে রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকাশক্তি জনপ্রশাসনে শুদ্ধি অভিযান চলছে জোরেশোরে। দলীয়করণের বৃত্ত ভেঙে পেশাদার ও জনবান্ধব প্রশাসন গড়তে কাজ করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ প্রক্রিয়ায় সচিব থেকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, সংস্থা ও প্রকল্পের পরিচালক পদে আনা হচ্ছে পরিবর্তন। পাশাপাশি বিগত সরকারের দলবাজি আর ব্যক্তি আক্রোশে বৈষম্যের শিকার ও পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তারা ন্যায়বিচার পেতে সরব হয়ে উঠেছেন। কিন্তু আড়ালে পড়ে গেছে এক কর্মকর্তার নিগৃহীত হওয়ার কাহিনী। স্রেফ মন্ত্রীর দুর্নীতি ও অবৈধ কর্মকাণ্ডে সায় না দেওয়ার কারণেই তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভাগ্যবিড়ম্বিত সেই কর্মকর্তা হলেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. মকবুল হোসেন। ২০২২ সালের ১৬ অক্টোবর কোনো অভিযোগ ছাড়াই তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছিল। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজমের স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে তাকে অবসরে পাঠানো হয়। তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ওই সময় গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘তাকে অবসর দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে—এটা জেনেছি। কিন্তু কেন অবসর দেওয়া হলো, সেই বিষয়ে আমি অবহিত নই।’ তবে মন্ত্রীর এই বক্তব্য নির্লজ্জ মিথ্যাচার ছিল বলে তখনই গুঞ্জন উঠেছিল। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী সরকারের দমন-পীড়নের ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পায়নি।
জানা গেছে, সচিব মকবুল হোসেনকে বিতাড়নের মূল নায়কই ছিলেন মন্ত্রী হাছান মাহমুদ। কেননা মন্ত্রীর নেতৃত্বেই মন্ত্রণালয়ে সক্রিয় ছিল দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট। মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তরে অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা পদায়ন করে দুর্নীতির মহাযজ্ঞ চালিয়েছেন। এ কাজে তার পিএস, এপিএসসহ কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন বিশ্বস্ত সহযোগী। মকবুল হোসেন ২০২১ সালের ৩০ মে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে যোগ দেন। তার আগে তিনি যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরে রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ঐ পদে যাওয়ার আগে তিনি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে যোগ দেওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন অনিয়ম, বিধিবহির্ভূত ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করে স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন মকবুল হোসেন। এমনকি সচিবকে পাশ কাটিয়ে অনেক নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত হয়েছিল। একপর্যায়ে বিষয়টি মন্ত্রীর নজরে আনার চেষ্টা করলেও সফলকাম হননি মকবুল হোসেন। বরং বিরাগভাজন হয়েছেন। তবে নিজের দুষ্কর্ম চাপা দিতেই বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি মন্ত্রী। এক্ষেত্রে নিজেকে নিরাপদ রাখতে মন্ত্রী বেছে নেন ঘৃণ্য অপকৌশল। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে সচিব মকবুল হোসেনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন। মকবুল হোসেনের রাষ্ট্রীয় কাজে লন্ডন সফরকে ঘিরে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা মওকাও পেয়ে যান। এরপরই সেসব সংস্থা থেকে কল্পিত অভিযোগ তুলে মনগড়া প্রতিবেদন দেয় সরকারের শীর্ষ মহলে।
যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকার পতনের লক্ষ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে মকবুল হোসেনের যোগাযোগ রয়েছে এবং সরকারের বিভিন্ন গোপন তথ্য তিনি বিএনপি নেতাদের কাছে সরবরাহ করেছেন। তাছাড়া লন্ডন সফরকালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে সরকার পতনের নীল নকশাসহ ভারত-বাংলাদেশ সরকারের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত মুজিব বায়োপিক (সিনেমা)-এর বাজেট সংক্রান্ত নথি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দলিল দস্তাবেজ তারেক রহমানের কাছে সরবরাহ করেছেন। আর সেই গোপন অভিযোগের ভিত্তিতেই কোনো রূপ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে বাধ্যতামলূক অবসরের কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আরও উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে, বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করেই তারা ক্ষান্ত হননি। মকবুল হোসেন যাতে কোথাও মুখ না খুলেন সেই জন্য নেওয়া হয়েছিল নানা ব্যবস্থা। একজন শীর্ষ আমলা এবং একটি সংস্থার কর্মকর্তারা তাকে মুখ না খোলার জন্য প্রচ্ছন্ন ভয়ভীতি দেখান। এমনকি ছয় মাস গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল। বন্ধু-বান্ধব দূরের কথা, আত্মীয়স্বজনও তার খোঁজ নিতে পারেনি।
কুষ্টিয়ায় জন্ম নেওয়া মকবুল বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের দশম ব্যাচের কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৯১ সালে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। একজন সৎ, কর্মঠ, অভিজ্ঞ ও দূরদর্শী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিতি থাকলেও মন্ত্রীর অর্থলিপ্সার বলি হতে হয়েছিল তাকে। পরিবর্তিত অবস্থায় তিনি এখন তার বিরুদ্ধে হওয়া অন্যায়ের বিচার ও প্রতিকার চান।
সূত্রঃ ইত্তেফাক