গত বছর প্রায় সব বাংলাদেশিরই আশ্রয় আবেদন প্রত্যাখ্যাত করেছে সাইপ্রাস৷ পাশাপাশি অনিয়মিত উপায়ে আসা অভিবাসীদের ঠেকাতে আরো কঠোর হচ্ছে দেশটির সরকার৷ সম্প্রতি সীমান্তে ইলেকট্রনিক নজরদারি ব্যবস্থা বসানোর ঘোষণা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনয়নভুক্ত দেশটি৷
‘বাফার জোন’ বা নিরাপদ অঞ্চলের সঙ্গে সীমান্তে কড়া নজরদারি ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে ইইউভুক্ত রিপাবলিক অব সাইপ্রাস৷ এর অংশ হিসেবে বসানো হবে ইলেকট্রনিক নজরদারি প্রযুক্তি৷ পুলিশ ও প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের বৈঠক শেষে গত মঙ্গলবার সরকারের মুখপাত্র মারিওস পেলেকানোস এমন সিদ্ধান্তের কথা জানান৷
এর মাধ্যমে দ্বীপের তুরস্ক নিয়ন্ত্রিত উত্তরাঞ্চল থেকে প্রয়োজনীয় কাগজ ছাড়া অভিবাসীদের দক্ষিণাংশে আগমন ঠেকানো যাবে বলে আশা করছে কর্তৃপক্ষ৷ উল্লেখ্য ১৯৭৪ সালে জাতিগত সংঘাতের জেরে অভিযান চালিয়ে সাইপ্রাস দ্বীপের উত্তরাংশ দখল করে নেয় তুরস্ক৷ তবে সেটি এখনো তুরস্কের ভূখণ্ড হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি৷
মূলত দুটি পথে অনিয়মিত উপায়ে রিপাবলিক অব সাইপ্রাসে প্রবেশ করেন অভিবাসী, শরণার্থীরা৷ কিছু অভিবাসী আসেন সমুদ্র পথে লেবানন বা আশেপাশের দেশ থেকে৷ তবে বড় অংশই সাইপ্রাসের তুরস্ক নিয়ন্ত্রিত অংশ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে আসেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত এই পথে দেশটিতে অভিবাসী প্রবেশের চেষ্টা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৯৪ শতাংশ বেড়েছে৷ এই পথে অভিবাসন বন্ধে নতুন নরজরদারি ব্যবস্থা চালু করতেই ১৮০ কিলোমিটার সীমান্তে নজরদারি প্রযুক্তি বসানো হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷
ইউরোমেড রাইটস নামের একটি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, নতুন প্রযুক্তি স্থাপনে গত বছরের অক্টোবরে ইসরায়েলের সঙ্গে দুই কোটি ৭৫ লাখ ইউরোর চুক্তি করেছে সাইপ্রাস৷ গত নভেম্বরে সাইপ্রাস সফরে আসেন ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷ ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, ক্যামেরুনসহ আফ্রিকার দেশগুলো যাতে আশ্রয় আবেদন বাতিল হওয়াদের সাইপ্রাস থেকে ফেরত নেয় সেজন্য দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরুর বিষয়ে কথা বলেন তিনি৷
অ্যাসাইলাম ইনফরমেশন ডেটাবেজ (এআইডিএ)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর বিভিন্ন দেশের ১৩ হাজার ৭৭৪ জন প্রথমবারের মতো আশ্রয় আবেদন করেছিলেন৷ তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তিন হাজার জন ছিলেন সিরিয়ার নাগরিক৷ বাংলাদেশিদের সংখ্যা ছিল ৬৮৬ জন৷ এদের মধ্যে চারজন শরণার্থী স্বীকৃতি ও একজন ‘সহায়ক সুরক্ষা’ পেয়েছেন৷ ২৯১ জনের আবেদন এখনও নিষ্পত্তি হয়নি৷ আগেরসহ গত বছর বাংলাদেশিদের ১,৯২২টি আশ্রয় আবেদন বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে৷ সব মিলিয়ে বাংলাদেশিদের আশ্রয় আবেদনের ৯৯ দশমিক সাত শতাংশই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে৷
আবেদন বাতিলের বিরুদ্ধে গত বছর বিভিন্ন দেশের মোট আট হাজার ৯৮৩ জন পুনর্বিবেচনার আপিল করেছেন৷ এর মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি দুই হাজার ২৩ জন৷ তাদের মধ্যে মাত্র একজন শরণার্থী সুবিধা পেতে সক্ষম হয়েছেন৷
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে ৬৯৮ অভিবাসী সাইপ্রাসে প্রবেশ করেছেন৷ যদিও ইউরোমেড রাইটসের ৮ মার্চ পর্যন্ত হিসাবে এই সংখ্যা ১,৩০০ জনের বেশি৷ তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নিষ্পত্তি হয়নি আগের বছরের এমন আশ্রয় আবেদনের সংখ্যাই ১৯ হাজারের বেশি৷
এদিকে, এত অভিবাসীদের জায়গা দিতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটি৷ এ নিয়ে সরকারের ব্যবস্থাপনা ঘাটতির সমালোচনা করে আসছে অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলো৷ অন্যদিকে বাড়তি অভিবাসীর চাপ সামলাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে বারবার সহায়তা আবেদন জানাচ্ছে সাইপ্রাস৷ এ বিষয়ে ফেব্রুয়ারিতে ইউরোপীয় কমিশন, ফ্রন্টেক্স ও ইউরোপল একটি সমঝোতা চুক্তি করেছে৷ এর অধীনের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ আবেদন বাতিল হওয়াদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া জোরদার করার কথা রয়েছে৷
অনিয়মিতভাবে আসা অভিবাসীদের সাইপ্রাস অনেক সময় অবৈধভাবে ফেরত পাঠাচ্ছে বলে অভিযোগ করে আসছে বিভিন্ন সংগঠন ও মানবাধিকারকর্মীরা৷ এআইডিএ-এর সাইপ্রাস নিয়ে ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘সাইপ্রাসের কর্তৃপক্ষ তুরস্ক ও লেবানন হয়ে আসা সিরিয়ান, লেবানিজ ও ফিলিস্তিনি নাগরিকদের বহনকারী নৌকা অবৈধভাবে পুশব্যাক অব্যাহত রেখেছে৷’’
এছাড়া স্থলপথে ‘বাফার জোন’ থেকে প্রবেশ করা ক্যামেরুনের তিনজন ও ১৮ বছর বয়সি নাইজেরিয়ার এক তরুণীকে ফেরত পাঠানোর তথ্যও দেয়া হয়েছে প্রতিবেদনে৷ ছয়মাস কাটানোর পর ক্যামেরুনের তিনজনের একজন পরবর্তীতে আবারও সাইপ্রাসে প্রবেশ করেন৷ বাকি দুইজন ডিসেম্বরে পোপ ফ্রান্সিস সফরে আসলে তার সঙ্গে ইটালি যাওয়ার সুযোগ পান৷
এআইডিএ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশটিতে আশ্রয় আবেদন গৃহীত হলেও অভিবাসী, শরণার্থীদের মূল ধারায় যুক্ত করার মতো যথাযথ ব্যবস্থা নেই৷ এছাড়াও অভিবাসীদের জন্য পারিবারিক পুনর্মিলন প্রক্রিয়াও বেশ কঠিন৷ এমনকি দশ বছর ধরে বসবাসের পরও অনেকে সেই সুযোগ পান না৷