শহিদুল ইসলাম, সহ-সম্পাদক: কুড়িগ্রাম সদর, রাজারহাট ও ফুলবাড়ী উপজেলা নিয়ে কুড়িগ্রাম-২ সংসদীয় আসন গঠিত। কুড়িগ্রামের চারটি আসনের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদার এ সদর আসনটি।
জানা গেছে, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আওয়ামীলীগ দলীয় প্রার্থী একবার এ আসনে সরাসরি নির্বাচিত হলেও বেশির ভাগ সময়ই জাতীয়পাটি ও বিএনপির প্রার্থীর দখলে ছিল আসনটি। বর্তমান এ আসনের এমপি জাতীয় পার্টির নেতা পনির উদ্দিন আহমেদ। প্রশাসন তথা জেলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এ আসনটি দখলে রাখার নিরন্তন চেষ্টা সব দলের। আগামী নির্বাচনে যে কোন মূল্যে এ আসনটি দখলে রাখতে চায় স্থানীয় আওয়ামীলীগ। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে জোড়ালো ভাবে। সেই সাথে তুলে ধরা হচ্ছে আওয়ামীলীগের উন্নয়নের ফিরিস্তি। বর্তমান সরকার কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক এর স্থান ও জায়গা নির্বাচন, ইকোপার্কের জায়গা নির্বাচন, কুড়িগ্রাম জেলার ৯টি উপজেলায় ১াট করে মডেল মসজিদ নির্মান, জেলায় প্রধানমন্ত্রীর উপহার গৃহহীনদের জন্য জমিসহ একটি করে প্রায় ৪ কিস্তিতে ৫ হাজার ঘর প্রদান, ধরলার দুই তীরে বাঁধ ও নদী খনন রোধের ব্যবস্থা করণ এবং শেখ হাসিনা ধরলা সেতু নির্মাণ। এসব কাজ এখন দৃশ্যমান। জেলার উন্নায়ন নিয়ে খুব খুশী আওয়ামীলীগের নেতা কর্মীদের সাথে সাধারণ ভোটাররা। তারপরও মহাজোটের অংশীদারীত্বে এ আসন ছাড়তে নারাজ জাপা। এ কারনে আগামী নির্বাচনে এ আসনে কোন দলের প্রার্থী মনোয়ন পাবে তা জানেনা কেউ। তবে তথ্যসূত্রে জানা যায় যে, আওয়ামীলীগের একাধিক প্রার্থী মনোনয়নের জন্য জোড় লবিং করছে কেন্দ্রে। স্থানীয়রা মনে করছেন এ আসনে আওয়ামীলীগে দুটি গ্রুপে বিভক্ত। এতে দ্বিধা বিভক্তিতে পড়েছে সাধারণ ভোটাররা।
স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতারা মনে করেন বড় দলের বিভক্তি খুব স্বাভাবিক। তবে নির্বাচন আসলেই এ বিভক্তি থাকবে না। নেত্রী যাকে মনোনয়ন দিবে তারা সকলেই ঐক্যব্ধ ভাবে কাজ করবে। ২০০৮ এর নির্বাচনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ এ আসনে নির্বাচিত হন। তিনি আসনটি ছেড়ে দিলে উপ-নির্বাচনে আওয়ামীলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মো: জাফর আলী বিপুল ভোটে বিএনপি প্রার্থী তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে পরাজিত করেন। এমপি নির্বাচিত হয়ে জাফর আলী দলীয় সহায়তায় কুড়িগ্রামে অনেক উন্নয়ন কর্মকান্ড সম্পন্ন করেন। কুড়িগ্রামের দুই আসনে বিএনপির অবস্থান ভাল থাকলেও দলটি দুুটি গ্রুপে বিভক্ত হওয়ায় জনপ্রিয়তা কমেছে। এক গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা অন্য গ্রুপে জেলা বিএনপির সভাপতি তাসবিরুল ইসলাম। এ আসনে বিএনপির সাধারণ ভোটার থাকলেও দলের বিভক্তি থাকার কারণে অনেক এক হতে পারছে না। আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের মাঝে এখন হতাশা রাড়ছে। সময় যত এগিয়ে আসছে ততই দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছেন তারা।
খোজঁ নিয়ে জানা গেছে জেলায় জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল। জেলা ও উপজেলায় পাল্টাপাল্টি কমিটির কারণে সাংগঠনিক তৎপরতা কমে গেছে। জেলায় জাতীয় পার্টির বলতেই বর্তমান এমপি পনির উদ্দিন আহমেদ। তিনি তার পছন্দের লোকজনদের দিয়েই বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনা করেন। জাতীয় পার্টির বিকল্প প্রার্থী হিসেবে বাংলাদেশ বিমানের সাবেক পরিচালক মেজর (অব:) আব্দুস সালাম বিলবোর্ড দিয়ে বিভিন্ন উৎসবে জনগনকে শুভেচ্ছা জানান। মাঝে মধ্যে নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগও করেন তিনি। মেজর সালাম জানিয়েছেন, তিনি মনোনয়নের ব্যাপারে যথেষ্ট আশাবাদী।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীরা মহাজোট সঙ্গী জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে বিজয়ী করলেও জাপা এমপির কাছে কোনও সুযোগ সুবিধা নিতে পারছে না বলে অভিযোগ স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের। সরকারি সকল বরাদ্দে নিজেদের একছত্র নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আওয়ামীলীগ নেতা কর্মীদের বঞ্চিত করে সমন্বয়হীনতার অভিযোগ জাতীয়পার্টির এমপির বিরুদ্ধে। এ অবস্থায় সাংগঠনিক স্বার্থে হেড কোয়ার্টার হিসেবে জেলা সদরের এই আসন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার পক্ষে ক্ষমতাসীন দলের।
আওয়ামীলীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা হচ্ছেন সাবেক সংসদ সদস্য, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জাফর আলী, সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আমান উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবু মোঃ সাঈদ হাসান লোবান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এজিএস সভাপতি অ্যাড.আব্রাহাম লিংকন, জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেদুজ্জামান বাবু, কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য, যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান যুবলীগের আহ্বায়ক আলহাজ্ব এডভোকেট মোঃ রুহুল আমিন দুলাল এবং নিটোর সাবেক পরিচালক ও ফুলবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তার মোঃ হামিদুল হক খন্দকার, তারা সবাই যার যার মতো করে গণসংযোগ ও সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন।
জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক, আমান উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু মহাজোটের বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির পনির উদ্দিন আহমেদের সম্বনয়হীনতার অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, জনগন সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড বঞ্চিত হচ্ছে। তাই উন্নয়নের স্বার্থে আমরা কুড়িগ্রাম-২ আসনে আমাদের দলীয় প্রার্থী চাই।
জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি আব্রহাম লিংকন জানান, আমি গ্রামে গঞ্জে ছুটছি। নেত্রী যদি একবার সুযোগ দেয় তা হলে জেলার ভাগ্য পরির্বতনে সর্বাত্মক চেষ্টা করবো।
তরুন নেতা আবু মোঃ সাঈদ হাসান লোবান জানান, জেলা আওয়ামীলীগ একটি সুংগঠিত দল। সারা দেশের একমাত্র জেলা কুড়িগ্রাম যেখানে সদর আসনের এমপি আওয়ামীলীগের নেই। ফলে এ অঞ্চলের মানুষ সাংসদিয় সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমরা ব্যাপক উন্নয়ন করেছি ও জনগনের কল্যানে নিয়োজিত আছি। তারপরও কেন দলীয় প্রার্থী হিসেবে বার বার মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জেলা আওয়ামীলীগ! দলীয় প্রধানের কাছে অনুরোধ করছি এবার যেন আমাদের দলীয় প্রার্থীকে এ আসনে মনোনয়ন প্রদান করেন।
যুবলীগ নেতা আলহাজ্ব এডভোকেট মোঃ রুহুল আমিন দুলাল বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশে অনেক উন্নয়ন করেছেন। এ উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে এবং গরিব অসহায় মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কুড়িগ্রাম সদর আসনে নৌকার বিকল্প নেই। কিন্তু গত নির্বাচনে মহাজোটের কারণে জাতীয় পার্টিকে আসনটি ছেড়ে দেয়ায় আমাদের সদর আসনটিতে অনেক উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এছাড়াও নদী বাঁধে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি জাপার বর্তমান এ সাংসদ। তবে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আবারও দেশের প্রধানমন্ত্রী করার লক্ষ্যে, দল থেকে নেত্রী যাকেই নমিনেশন দেবেন সকলে মিলে তার পক্ষেই কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন যুবলীগ এ নেতা।
বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়, গত সংসদ নির্বাচনে কুড়িগ্রাম ২ আসনের মনোনয়ন সম্পর্কিত বিভিন্ন জনমত জরিপে এবং ক্লিন ইমেজের দিক থেকে সারা বাংলাদেশের মধ্যে ২০৯ নম্বর সিরিয়ালে ছিলেন যুবলীগ এই নেতা।
এদিকে ফুলবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) সাবেক পরিচালক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তার মোঃ হামিদুল হক খন্দকারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি বলেন, আমার পেশাই হচ্ছে ডাক্তারি তথা মানুষকে সেবা দেয়া। এখন চাকরি থেকে আমি অবসরে আছি। দল থেকে আমাকে নমিনেশন দেয়া হলে কুড়িগ্রাম সদরে আসনটিতে অনেক উন্নয়ন ও গরিব মানুষের আরও বেশি সেবা করতে পারবো।
জাতীয় পার্টির বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে, মনোনয়নের জন্য বর্তমান সদর আসনের এমপি পনির উদ্দিনও জোর লবিং চালাচ্ছেন। যদি মহাজোট এবারও হয় তবে জাতীয় পার্টিই এই আসনে প্রার্থী হবে। তারা কোন অবস্থায় আওয়ামীলীগকে ছাড় দিবেন না।
জাতীয় পার্টির এমপি পনির উদ্দিন আহমেদ বলেন, আগামী নির্বাচনও মহাজোটের অধীনে হবে। জোটের সিন্ধান্তই চুড়ান্ত। জোট যাকেই মনোনয়ন দেবে আমি তার পক্ষেই কাজ করবো। তবে অবশ্যই জাতীয়পার্টি থেকে আমি মনোনয়ন চাইবো।
অন্যদিকে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য, সাইফুর রহমান সরকারি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও বিটিসিএল এর সাবেক ইঞ্জিনিয়ার সাইফুর রহমানও জাতীয় পার্টি থেকে নমিনেশন’র জন্য কেন্দ্রে জোর লবিং চালাচ্ছেন বলে তথ্য সূত্রে জানা যায়। তিনি বলেন, আমি এলাকায় গরিব মানুষদেরকে নিয়ে কাজ করে আসছি দীর্ঘদিন থেকে। কুড়িগ্রাম সদর আসনে উন্নয়নের স্বার্থে মহাজোট তথা জাতীয় পার্টির কোন বিকল্প নেই।
আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত প্রার্থী নিয়ে চিন্তার কোনও সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা। তারা আন্দোলনের মধ্যে আছেন এবং আন্দোলন সফল হওয়ার পরই তারা প্রার্থী নিয়ে চিন্তা ভাবনা করবেন। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা এবং সহ-সভাপতি শফিকুল ইসলাম বেবু সহমত পোষন করেন। তবে আগামী সংসদ নির্বাচনে বি এন পি অংশ গ্রহন করলে কুড়িগ্রাম-২ আসন থেকে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব অ্যাড. রুহুল কবির রিজভী, জেলা বিনপির সহভাপতি শফিকুল ইসলাম বেবু, জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়’র সোহরাওয়ার্দী হলের সাবেক ভিপি অধ্যাপক হাসিবুর রহমান হাসিব, ব্যারিষ্টার রবিউল আলম সৈকতের নাম শোনা যাচ্ছে।
যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক হাসিবুর রহমান জানান, এ আসনে প্রচুর বিএনপির ভোটার রয়েছে। ভোট নিরপেক্ষ না হলে সেই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও ফলাফল ভাল হবে না। মাঠের কর্মীরা বর্তমান সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনে সম্পৃক্ত হতে ইচ্ছুক নয়। এ ছাড়া প্রশাসনিক বিভিন্ন ধরনের হয়রানি দলের কর্মীদের সাংগঠনিক কাজে বাঁধার সৃষ্টি করছে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলা সভাপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, আগামী নির্বাচন নিয়ে এখনও তাদের তৎপরতা শুরু হয়নি। তারা শুধু দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ থাকলে তাদের দল থেকে তিনি নিজে এবং সহযোগী সংগঠন ইসলামী শ্রমিক আন্দোলনের জেলা সভাপতি মো. শাহাজাহান মিয়া, ডা.আবুল কালাম আজাদ দলীয় মনোনয়নের জন্য জোর লবিং চালাচ্ছেন।