জাওয়াদ তাহের:রহস্যেঘেরা এ পৃথিবীতে মহান আল্লাহ তাআলা কোনো অনর্থক হুকুম দেননি। আল্লাহ তাআলার প্রতিটি আদেশে রয়েছে নিগূঢ় রহস্য। অনেকাংশে তা আমাদের বুঝে আসে না। তেমনি আল্লাহর এক হুকুম জাকাত।জাকাত ইসলামের তৃতীয় রোকন ও খুঁটি। কোরআনে কারিমে নামাজ কায়েম এবং জাকাত আদায়ের কথা সত্তরের বেশি জায়গায় একসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায়, ইসলামে নামাজ ও জাকাতের গুরুত্ব এক ও অভিন্ন। এবং এই জাকাত আদায়ে মানবজীবনে প্রভূত কল্যাণ আছে। নিম্নে সে বিষয়ে আলোচনা করা হলো—
এক. মানুষের অন্তরকে কার্পণ্যমুক্ত করা। এর মাধ্যমে সে মন্দ চরিত্র থেকে পবিত্রতা লাভ করে। অর্থের মোহ মানুষকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়। এটি একটি ঈমানবিধ্বংসী রোগ। আর জাকাতের মাধ্যমে এর চিকিৎসা অর্থাৎ মন্দ ও বিষাক্ত প্রভাব থেকে নিজের আত্মার পরিশুদ্ধি ঘটে। যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আপনি তাদের সম্পদ থেকে সদকা (জাকাত) গ্রহণ করুন। এর দ্বারা আপনি তাদের পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন। আর আপনি তাদের জন্য দোয়া করুন। আপনার দোয়া তো তাদের জন্য প্রশান্তিদায়ক। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (সুরা তাওবা, আয়াত : ১০৩)
দুই. অসহায় দুস্থ দরিদ্রদের সাহায্য সহযোগিতা করা। ইসলাম সর্বদা অসহায় গরিবদের সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য উৎসাহ প্রদান করে। এতে ধনী-গরিবের বিভেদ কমে আসবে। দাতা ও গ্রহীতার মাঝে ভালোবাসার বন্ধন তৈরি হবে। অপরাধপ্রবণতা কমে আসবে। সুদের কালো থাবা থেকে মুক্ত হবে আমাদের সমাজব্যবস্থা। জাকাতের মাধ্যমে একে অপরের মাঝে ভালোবাসা ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পায়। হিংসা-বিদ্বেষ দূর হয়ে যায়। মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। অন্যের ব্যথায় সেও ব্যথিত হবে—এটাই একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্য। নোমান ইবনে বশির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘পারস্পরিক দয়া, ভালোবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শনে তুমি মুমিনদের একটি দেহের মতো দেখবে। যখন শরীরের একটি অঙ্গ রোগে আক্রান্ত হয়, তখন শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রাত জাগে এবং জ্বরে আক্রান্ত হয়। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০১১ )
তিন. সম্পদের সুরক্ষা হয় সঠিকভাবে জাকাত আদায়ের মাধ্যমে। জাকাতের মাধ্যমে চুরি-ডাকাতি আকস্মিক কোনো বিপদাপদ থেকে রক্ষা পায়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন তুমি তোমার সম্পদের জাকাত আদায় করবে, তখন এর অনিষ্ঠতা থেকে রক্ষা পাবে। ’ (মুসতাদরাক হাকেম, হাদিস : ১৩৯০)
চার. মহান আল্লাহর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা আদায় করা। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাকে সম্পদ দিয়ে পরীক্ষা করেন এবং সম্পদ না দিয়ে পরীক্ষা করেন। যাদের আল্লাহ তায়ালা সম্পদ দিয়েছেন তাদের পরীক্ষাটা এভাবে যে সে তার সম্পদকে কিভাবে খরচ করছে, আল্লাহ তাআলার হুকুম মেনে, নাকি তার মনমতো শুধু সম্পদ খরচ করছে? কারণ মানুষ তার সম্পদের প্রতি বেশি আগ্রহী থাকে। তার প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর হুকুমে সে কতটুকু খরচ করে—এটা তার জন্য একটা পরীক্ষা।
পাঁচ. মহান আল্লাহর হুকুম, ঈমান আনার পর নামাজের মতো জাকাত প্রদান করা। নামাজ ও জাকাতের পাবন্দি ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য হওয়া অসম্ভব। যেভাবে নামাজে কেয়াম, রুকু, সিজদার মাধ্যমে মহান আল্লাহ তাআলার দরবারে নিজের দাসত্ব প্রকাশ করে, যাতে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও তাঁর নৈকট্য লাভ করতে পারে। তেমনি জাকাতের মাধ্যমেও সম্পদের আর্থিক নজরানা পেশ করে। এভাবে সে এ কথার বাস্তব প্রমাণ পেশ করে যে তার কাছে যা কিছু আছে এটা নিজের নয়; বরং আল্লাহপ্রদত্ত। জাকাতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও তাঁর পক্ষ থেকে বড় প্রতিদান পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আমার দয়া তা তো প্রত্যেক বস্তুকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছে। কাজেই আমিই তা লিখে দেব তাদের জন্য, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, জাকাত দেয় ও আমাদের আয়াতসমূহে ঈমান আনে। ’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ১৫৬)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, আর তোমরা নামাজ কায়েম কোরো, জাকাত দাও এবং রাসুলের আনুগত্য করো, যাতে তোমাদের ওপর রহম করা যায়। (সুরা নুর, আয়াত : ৫৬)
ছয়. নিজের সম্পদকে পবিত্র করা এবং এর মাধ্যমে নানা ধরনের বিপদ থেকে নিজেকে হেফাজত করা। যারা জাকাত প্রদান করে আল্লাহ তাআলা তাদের সম্পদে বরকত দান করেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সদকা দ্বারা সম্পদ হ্রাস হয় না। ’ (মুসলিম, হাদিস : ৬৪৮৬)
যারা জাকাত প্রদান করে না, আল্লাহ তাআলা তাদের বিভিন্ন বালামসিবত দিয়ে থাকেন, বিপদাপদ দিয়ে থাকেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যারা জাকাত আদায় করবে না, আল্লাহ তাআলা তাদের বিভিন্ন ধরনের মহামারিতে আক্রান্ত করবেন। ’ (তাবরানি, হাদিস : ৪৫৭৭)
মহান আল্লাহ আমাদের জাকাতভিত্তিক সমাজ গড়ার তাওফিক দান করুন।