রাজশাহী: – রাজশাহীতে দিনে দিনে বেড়েই চলছে অবৈধ ইটভাটা। পরিবেশ অধিদফতরের কাছ থেকে হাতেগোনা কিছু ইটভাটা ছাত্রপত্র নিলেও অন্যসব ইটভাটা স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযেগ স্থানীয়দের।
পরিবেশ অধিদফতরের দেয়া তথ্যানুযায়ী, রাজশাহী জেলায় প্রায় ১২০টি ইটভাটা রয়েছে। সর্বোচ্চ ৪০টি ইটভাটার ছাড়পত্র ও লাইসেন্স আছে। অধিকাংশের পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও লাইসেন্স নেই।
এরমধ্যে পবা উপজেলায় রয়েছে প্রায় ৫০টি। এসব ইটভাটার প্রায় সবকটিতে পুড়ানো হচ্ছে কাঠ। এমন একটি ইটভাটার মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বর্তমানে ইটের যে দাম তাতে ভাটাই শুধু কয়লা পুড়ালে পথে নামতে হবে।গতবছরে প্রতি টন কয়লার দাম ছিল প্রায় ১১ হাজার টাকা, এবারে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩-২৪ হাজার টাকা। কিন্তু সেই তুলনায় ইটের দাম বাড়েনি। প্রেক্ষিতে অনেকটা নিরুপায় হলেই কাঠ পুড়ানো হচ্ছে। পবা উপজেলার পারিলা ও হরিয়ান ইউনিয়নের প্রায় অর্ধেক কৃষি জমিতে ইটভাটা ও অপরিকল্পিত পুকুরখনন হয়েছে।
সরোজমিনে হরিয়ানের কু-খন্ডি গ্রামে হানিফ মোহাম্মদ পলাশের, নাজালের এমএসবি ইটভাটা, পারিলার রামচন্দ্রপুর হাটের পাশে বাবুর ভাটায় অবাধে পুড়ানো হচ্ছে কাঠ। পাশাপাশি অবৈধ এসব ইটভাটায় উর্বর ফসলি জমির টপ সয়েল পুড়িয়ে ইট তৈরী হচ্ছে।
এমনকি একই মালিক তিন ফসলী কৃষি জমিতে পুকুরখনন করছে এবং সেই মাটির টপ সয়েল ইটভাটাই আনা হচ্ছে। অবাধে কাঠ পুড়ানোর ফলে একদিকে বনায়ন উড়ার হচ্ছে এবং অন্যদিকে কাঠ পোড়ানোয় বায়ুদূষনে রোগ-ব্যাধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে মূল্যবান সম্পদ আমসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফল উৎপাদনও হুমকিতে পড়েছে। এ ছাড়াও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে লাখ লাখ মানুষ।
পবা উপজেলায় সরকারি অনুমোদন ছাড়াই নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে ইটভাটা। এসব ভাটা ফসলি জমি, বসতবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বনাঞ্চল ও পাকা সড়কের পাশে অবস্থিত। পুরো জেলাতেই ইটভাটার ক্ষেত্রে একই অবস্থা। পুকুর কাটছে, ভাটা চালাচ্ছে, কাঠ পুড়াচ্ছে।
সরকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নের স্বার্থে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করে। কিন্তু আইন রয়েছে আইনের জায়গায়, বাস্তবে এর নেই কোনো প্রয়োগ নেই। টপ সয়েল দিয়ে তৈরী হচ্ছে ইট। গ্রামীণ সড়ক ব্যাবহার করে পরিবহন করা হচ্ছে মাটি ও ইট। এসব ইট ভাটায় প্রকাশ্যে মাটি ও গাছের খড়ি (কাঠ) ক্রয় করা হচ্ছে। এতে শুধু ফসলী জমিই নষ্ট হচ্ছে তা নয় রাস্তা ঘাট, পরিবেশসহ ধ্বংস হচ্ছে প্রাণীকুলও। আবার ইটের পরিমাপের ক্ষেত্রে আছে শুভংকরের ফাঁকি। দারুন কায়দায় চুরি হচ্ছে ইটের মাটি।
সূত্র জানায়, ভাটায় তৈরী ইটের প্রকৃত মাপ হবে ১০ ইঞ্চি লম্বা, ৫ ইঞ্চি চওড়া এবং ৩ ইঞ্চি উচ্চতা। কিন্তু সেটা থাকছে ৯ ইঞ্চি লম্বা, ৪ ইঞ্চি চওড়া ও আড়াই ইঞ্চি উচ্চতা। যথারীতি ক্রেতার সাথে প্রতারণা করলেই প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করছে।এসব ভাটার কারণে পরিবেশ ও ফসলি জমির ক্ষতির অভিযোগ উঠেছে। এরপরও ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন লঙ্ঘনকারী এসব ভাটাগুলোর বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের এক কর্মকর্তা জানান, ইটভাটা থেকে নির্গত ছাই আশপাশের গাছপালা ও ফসলের মারাত্মক ক্ষতির কারণ। ছাই ও বস্তুকণা গাছের পত্ররন্ধ্র বন্ধ করে দেয়। উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ ও শ্বষণ প্রক্রিয়াকেও মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। কার্বন-ডাই অক্সাইড ও সালফার-ডাই অক্সাইড মিশ্রিত ছাই আম, ধান, লিচু, কাঁঠাল, শিম, কুমড়া, সরিষাসহ বিভিন্ন ফসলের রেণুকে নষ্ট করে দেয়। এতে ফসলের উৎপাদনও মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা জানান, এক ফসলি বা অনাবাদি জমিতে ইটভাটা নির্মাণ করা যায়। কিন্তু রাজশাহীর বেশির ভাগ ইটভাটা গড়ে উঠেছে দুই অথবা তিন ফসলি জমিতে। কোনো কোনো সময় ভাটা মালিকরা জমি কিনে নিয়ে কয়েক বছর ধরে অনাবাদি ফেলে রাখেন। পরে অনাবাদি দেখিয়ে ছাড়পত্র নেন। ভাটা মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় কৃষি বিভাগেরও কিছুই করার থাকে না। তারা নানাভাবে পার পেয়ে যান।
রাজশাহী জেলা পরিবেশ অধিদফতরের সহকারি পরিচালক কবির হোসেন জানান, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এরআগে বাগমারা, চারঘাটে ইটভাটায় জরিমানা করা হয়েছে। আমাদের একটা বিষয় মনে রাখতে হবে-ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা আদায়সহ শাস্তি দেয়া যায় কিন্তু সচেতন করা যায় না। তাছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় প্রস্তুতি দরকার হয়। জেলা প্রশাসন থেকে ম্যাজিস্ট্রেট নিতে হয়। যা সময় সাপেক্ষ হয়ে উঠে।তবে এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদফতরের গাফিলতির অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
রাজশাহী পরিবেশ অধিদফতরের অন্য এক কর্মকর্তা বলছেন, জনবল সঙ্কটে কার্যক্রম জোরদার করা সম্ভব হচ্ছে না। বিভিন্ন সময়ে চিঠি দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু সাড়া মেলেনি।
রাজশাহী ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি সাদরুল ইসলাম জানান, নিবন্ধন প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘ এবং জটিল। মোটা বিনিয়োগের পর পুরো প্রক্রিয়া পর্যন্ত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। তাদের কেউ কেউ ছাড়পত্র না পেলেও একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকেই ইটভাটা চালু করেন। তিনি বলেন, বৈধভাবেই ব্যবসা করতে চান তারা।
ভাটা মালিকরা জানান, আইনি নানা জটিলতার কারণে ছাড়পত্র ও লাইসেন্স পাচ্ছেন না তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ভাটা মালিক বলেন, প্রক্রিয়া জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই কোনো কোনো সময় চাঁদা দিয়ে ইটভাটা চালাতে হয়।