রোজা এমন একটি শিক্ষা যে এর কার্যপ্রক্রিয়া অন্যের থেকে নয়, বরং নিজের থেকে শুরু হয়। একজন রোজাদার নিজেকে বিপদে ফেলে, নিজেকে ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত রাখে। মানে রোজা এমন এক অনুশীলন যার সম্পর্ক কেবল নিজের সঙ্গে। প্রকৃত রোজাদার তিনিই যিনি রোজা পালন করেন এবং রোজার এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেন।
রোজা মানুষের জন্য আল্লাহর নিষিদ্ধ জিনিস থেকে মুক্ত জীবনযাপন করার জন্য এক বার্ষিক অনুশীলন। এমতাবস্থায় যে ব্যক্তি খাদ্য ও পানীয় ত্যাগ করে রোজা রাখে কিন্তু হিংসা-বিদ্বেষ, মিথ্যা ও অন্যায় ইত্যাদি পরিত্যাগ করে না, সে রোজা রেখেও রোজা রাখলো না। সে যেন আল্লাহর জায়েজ জিনিস খেয়ে রোজা রাখলো, আর আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা খেতেই থাকলো।
মিথ্যা বলার অর্থ এই যে— একজন ব্যক্তি তার কথাবার্তায় সর্বদা সঠিক কথা বলে না। যাইহোক, কেবলমাত্র শুধু ওই ব্যক্তি মিথ্যাবাদী নয়, যে ইচ্ছাকৃতভাবে একটি পূর্ব ধারণা অনুসারে মিথ্যা বলে, ওই ব্যক্তিও মিথ্যাবাদী, যে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা বলে না, কিন্তু এমন কিছু বলে যা কার্যত মিথ্যা। সে বর্তমান দুনিয়ায় মিথ্যার ভিত্তিতে লাভের চেষ্টা করে, সত্যের ভিত্তিতে নয়।
মানুষ একটি সামাজিক জীব। সে এই পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের পুরুষ ও নারীদের সঙ্গে বসবাস করে। এই সামাজিক সম্পর্কের সময় বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এসব পরিস্থিতি মানুষের মধ্যে উস্কানি ও প্রতিক্রিয়া এবং হিংসা-বিদ্বেষ ও অবিচার ইত্যাদি মানসিকতা উস্কে দেয়।
এই রকম পরিস্থিতিতে মানুষ কি করবে আর কি করবে না, তা ঠিক করার জন্যই রোজা ফরজ করা হয়েছে।
কুরআনে রোজাকে তাকওয়া শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে (বাকারা, ২: ১৮৩) আর হাদিসে রমজান মাসকে ধৈর্যের মাস (শাহরুস সবর) বলা হয়েছে (শু’বুল-ইমান, হাদিস নং ৩৩৩৬)।
ধৈর্য এবং নীতির বিষয়ে অবিচল থাকা নিঃসন্দেহে জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি। এটাই সকল বিজয় ও সাফল্যের রহস্য। সত্যিকারের রোজা ধৈর্যের জন্ম দেয় এবং ধৈর্যই এমন জিনিস যা সকল সফলতার দরজা।
রোজার আরবি শব্দ হলো ‘সাওম’। যার অর্থ হল বিরত থাকা। সাওম মানে স্টপার। প্রাচীনকালে ঘোড়া ছিল মানুষের কঠিন সময়ে সবচেয়ে বড় সঙ্গী। যুদ্ধ এবং কঠিন ভ্রমণে দরকার হত ঘোড়া। এই উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণের একটি উপায় ছিল ঘোড়াটিকে সীমিত সময়ের জন্য ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত রাখা, যাতে এটি সর্বাধিক কষ্ট সহ্য করতে পারে।
এই ধরনের প্রশিক্ষিত ঘোড়াকে খায়লুস সাইম (রোজাদার ঘোড়া) বলা হয়। সুপরিচিত প্রাচীন আরব কবি নাবগা জুবয়ানি যুদ্ধক্ষেত্রে ঘোড়ার বর্ণনায় বলেছেন যে, কিছু ঘোড়া রোজায় ছিল, এবং কিছু ঘোড়া রোজায় ছিল না।
রোজাদার মানে এমন ব্যক্তি যে সাময়িকভাবে খাওয়া-দাওয়া এবং বৈবাহিক শারীরিক সম্পর্ক থেকে নিজেকে দূরে রাখে। এই বর্জন ও পরিহার মানুষের মধ্যে ধৈর্যের ক্ষমতা তৈরি করে, সে সক্ষম হয়ে ওঠে কঠিন পরিস্থিতির পুরোপুরি মোকাবেলা করতে, সে কোনো অবস্থাতেই নেতিবাচক মানসিকতার শিকার হয় না।
রমজান মাস মানুষের জন্য তার অহংকার এবং তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে লড়াই করার মাস। এটি সেই মাস যখন মোমিন অশুভ শক্তিকে পরাস্ত করে এবং তাদের পরাস্ত করে পুনরায় আল্লাহর উপাসনা করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে নতুন বছরে প্রবেশ করে।
ইতিহাস অলৌকিকভাবে রোজার এই বৈশিষ্ট্যটি নিশ্চিত করে। তাই, আধ্যাত্মিক সংগ্রামের এই মাসটি ইসলামের ইতিহাসে সামরিক সংঘাতের মাসও।
উদাহরণস্বরূপ, বদরের যুদ্ধ যেটা সংঘটিত হয়েছিল দ্বিতীয় হিজরির রমজান মাসে, যখন নবী এবং তাঁর সঙ্গীরা আল্লাহর সাহায্যে মক্কার কোরায়েশদের উপর একটি নির্ণায়ক বিজয় অর্জন করেছিলেন। একইভাবে মক্কা বিজয় (রমজান, ৮ হিজরি) যা সমগ্র আরবে ইসলাম নিয়ে আসে।
অভিভূত এই ধরনের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো দেখায় যে, রোজা রাখার কষ্টগুলো একজন মানুষকে দুর্বল করে না; বরং, এটি তাকে জীবনের প্রতিযোগিতায় আরও বেশি শক্তি ও সংকল্পের সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম করে, সেটা বাহ্যিক প্রতিযোগিতা হোক বা তার নিজের বিরুদ্ধে হোক। (সংগৃহীত)