স্বপ্নের পদ্মা সেতুকে ঘিরে পরিবহন ও যোগাযোগের নতুন দুয়ার খুলবে বলে স্বপ্ন বুনছে ঝিনাইদহ জেলাসহ দক্ষিণের মানুষ। যোগাযোগ সহজীকরণের ফলে অর্থনীতিতে যুক্ত হবে বহুমুখিতা, এখানকার মানুষের জীবনে আসবে ব্যাপক পরিবর্তন।
ঝিনাইদহ জেলা দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম প্রবেশদার। রাজধানীর সাথে এই জেলার উপর দিয়ে যশোর হয়ে বেনাপোল স্থল বন্দর, চুয়াডাঙ্গা হয়ে দর্শনা স্থলবন্দর পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। বেনাপোলের ওপারে ভারতের পেট্রাপোল ও দর্শনার ওপারে গেদে স্থলবন্দর। এসব স্থল বন্দর দিয়ে সড়ক পথে ঝিনাইদহের উপর দিয়ে আমদানি রফতানি হয়। এছাড়া বিভাগীয় শহর খুলনা থেকে ঝিনাইদহের উপর দিয়ে কুষ্টিয়া হয়ে উত্তরবঙ্গের ও রাজধানীর যোগাযোগ রয়েছে। এইভাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের সেতুবন্ধনের ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী জেলা ঝিনাইদহ। এই জেলার সাথে রাজধানী প্রধান যোগাযোগ সড়ক পথে হয়ে থাকে। রেল পথেও বিকল্প যোগাযোগ রয়েছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় পদ্মা সেতুর উপর ফেরিঘাট।
পরিবহন মালিক আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে প্রায় সময় যানজট লেগেই থাকে। এর ফলে ঝিনাইদহ জেলা সদর থেকে ঢাকার সড়ক পথ ২০০ কি:মি: পাড়ি দিতে যেখানে ৪/৫ ঘন্টা সময় লাগার কথা সেখানে ১০/১৫ ঘন্টও লেগে যায়। একারণে একদিকে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। পঁচনশীল কৃষিপণ্য মাঝপথেই নষ্ট হয়ে কৃষিক্ষেত্রে অপুরণীয় ক্ষতি হয়। স্থলবন্দরসহ উত্তর, দক্ষিণাঞ্চল থেকে রজধানীসহ সারা দেশে পণ্য পরিবহনে দীর্ঘ সময় নষ্ট হয়। এছাড়া ফেরিঘাটে যানজটের কারণে মরণাপন্ন রোগিকে ঢাকায় নিয়ে যেতে পথে মাঝে মাঝে প্রাণহানির মত মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। এমন নানা মুখি বিপর্যয়ের সম্মুখিন হতে হয় এঅঞ্চলের জনসাধারণের।
ঝিনাইদহ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্টিজের সহ- সভাপতি নাসিম উদ্দিন জানান, পদ্মা সেতু ঝিনাইদহ জেলাসহ এ অঞ্চলের অর্থনীতি ও সমাজে আনবে অকল্পনীয় পরিবর্তন। এ সেতু চালু হওয়ার পর সড়ক ও রেল-দুই পথেই দক্ষিণ বাংলার মানুষ অল্প সময়ে ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবেন। দিনের পর দিন আর পণ্যবাহী ট্রাকগুলোর ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় বসে থাকবে না। আর ঝড়বৃষ্টিতে ফেরি বন্ধ থাকার কারণে মানুষের যাতায়াতও থমকে থাকবে না। সেতুটির কারণেই প্রথমবারের মতো পুরো দেশ একটি সমন্বিত যোগাযোগ কাঠামোতে গড়ে উঠবে। এতদাঞ্চলের গ্রামাঞ্চলেও পরিবর্তনের হাওয়া লাগবে। কৃষক, মৎস্যজীবী, তাঁতি, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভোক্তার সমাবেশ রাজধানী ঢাকার সঙ্গে অনায়াসে সংযুক্ত হতে পারবেন। অন্যদিকে তারা রাজধানী থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে পরিবহনযোগে নিয়ে যেতে পারবেন তাদের গ্রামের ও আশপাশের এসএমই উদ্যোগগুলোর কাছে।
ঝিনাইদহ বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন জুলিয়াস জানালেন, এরই মধ্যে পদ্মা সেতু উদ্বোধন হবে শুনেই ব্যবসা-বাণিজ্যের ধরণ পাল্টাতে শুরু করেছে। জেল শহরের আশপাশের জমির দাম বাড়ছে। নানা ধরনের এসএমই প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যাগ নিচ্ছেন শিল্প উদ্যোক্তারা।
ঝিনাইদহের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এ্যাড. ইসমাইল হোসেন জানালেন, পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে রেলের পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেট অবকাঠামোও স্থাপিত হবে জানাযায়। এর ফলে স্থল বন্দর দিয়ে কলকাতার সঙ্গে ঝিনাইদহসহ ঢাকার যোগাযোগের সময় প্রায় অর্ধেকে নেমে আসবে। এর প্রভাব বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও নেপালের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।
ঝিনাইদহ সরকারি কে.সি. কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ্য প্রফেসর ড. বিএম রেজাউল করিম বলেন, ঝিনাইদহ কৃষি প্রধান অঞ্চল। পণ্য সরবরাহ সহজ হলে কৃষি উৎপাদনসহ বাড়বে কর্মসংস্থান। আর সেটা হলে এখন যে জলবায়ু চ্যালেঞ্জের শিকার অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসে ঝুঁকিপূর্ণ অনানুষ্ঠানিক কাজকর্ম করতে বাধ্য হচ্ছে, তাদের সংখ্যা কমে আসবে। এতদাঞ্চলে নতুন-নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে।
প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, সেতুর কারণে যোগাযোগ ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত হলে সঙ্গে-সঙ্গে টাকাও হাত ঘুরবে দ্রুত হারে। অর্থনীতিতে যুক্ত হবে বহুমুখিতা। বাড়বে মানুষের আয়-রোজগার। বাড়বে ভোগ ও চাহিদা। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর আর্থসামাজিক পরিবর্তন আরও দ্রুতলয়ে ঘটবে। কেননা পদ্মা সেতুর কারণেই আঞ্চলিক যোগাযোগ এক নতুন মাত্রা পাবে। ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে ও রেলওয়ের সঙ্গে পুরো বাংলাদেশের সংযোগ ঘটবে। তাছাড়া তামাবিল থেকে বেনাপোল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের ফলে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্যে বিস্ফোরণ ঘটবে।
ঝিনাইদহের ট্রাক ড্রাইভার আমিন বিশ্বাস পদ্মা সেতু নিয়ে আবেগাপ্লুত। তিনি বলেন, আগে ঢাকায়ে আসা-যাওয়া ছিল অনিশ্চিত। প্রায়ই দীর্ঘ সময় লেগে যেতো ঢাকা শহরে যেতে। পদ্মা সেতু হয়ে গেছে। এখন দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসতে পারব। আগে পদ্মা সেতুর কথা মানুষের মুখে মুখে শুনতাম। এখন পদ্মা সেতু কারণে আমাদেরও জীবনের পরিবর্তন আসবে।
ব্যবসায়ী আব্দুস সালাম বলেন, জেলার যেসব পণ্যদ্রব্য ঢাকা শহরে পাঠাতে হয়, সেগুলো এখন আর লঞ্চে যাবে না, সরাসরি ট্রাকে করে ঢাকায় চলে যাবে। পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য আরও বেশি ত্বরান্বিত হবে। আবার পদ্মার ওপারের ব্যবসায়ীরাও আমাদের জেলায় এসে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে পারবে। চালু হবে শিল্পকারখানা। এই উন্নয়নটুকু আমাদের জীবনের জন্য অনকে বড় কিছু।
শিক্ষক স্বপন সাহা জানান, ক্লাসে যখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে কথা বলি, তখন গর্বে বুকটা ভরে যায়। একটি দেশের সামগ্রিক উন্নতি অনেকাংশে নির্ভর করে সেই দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর। স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাংলাদেশর জন্য আরও একটি মাইলফলক। এই স্বপ্নের সেতু বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের বিশেষ করে ঝিনাইদহ জেলার মানুষ বেশি উপকৃত হবে।
ঝিনাইদহ জেলা পরিষদ প্রশাসক কনক কান্তি দাস ফেরি ও লঞ্চের বিভিন্ন অসুবিধার কথা উল্লেখ করে বলেন, যাতায়াতের দুর্ভোগ কমিয়ে পদ্মা সেতু বাংলাদেশের পরিবহন ও সড়ক ব্যবস্থার ইতিহাসে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। ধন্যবাদ জানাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে, যার সাহসিকতা ও অক্লান্ত পরিশ্রমে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের অপেক্ষা করছে। পদ্মা সেতুর জন্য রইল শুভকামনা।-বাসস