দেশে ১৩ মাসে এক হাজারের বেশি নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে হত্যা কাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা বেশি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে সারা দেশে ৪৪ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। সেই হিসাবে ১৩ মাসে ৫২৯ জন শিশুকে হত্যা করা হয়। পুলিশ ও মানবাধিকার সংস্থা, আইন ও সালিশ কেন্দ্র সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সমাজ বিশ্লেষক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে সম্প্রতি সারা দেশে খুনখারাবির মতো অপরাধ বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধ করেও আইনের ফাঁকফোকর গলে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের পার পাওয়া বা বিচার থেকে রেহাই পাওয়ার বিষয়টিও এতে ইন্ধন জোগাচ্ছে।
এসব হত্যার বেশির ভাগ ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে সামাজিক, পারিবারিক ও আর্থিক বিরোধের জের ধরে তুচ্ছ কারণে মানুষ একে অপরকে হত্যা করছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এসব ঘটনা আরেকবার সামাজিক পরিসরে কুৎসিত কর্মকাণ্ডের ভয়াবহ চিত্রও সামনে নিয়ে এসেছে। এসব ঘটনার জন্য নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কে দায়ী করছেন সমাজবিদ, মনোবিদ ও অপরাধ বিশ্লেষকরা।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সামাজিক পরিবর্তন, পারিবারিক মূল্যবোধ ও বন্ধন অনেকটা ভেঙে গেছে। বিশ্বায়নের যুগে মানুষের মধ্যে লোভ ও উচ্চাভিলাষ বাড়ছে। অবক্ষয ঘটছে নৈতিকতার। এ ছাড়া সমাজের বিভিন্ন বিশৃঙ্খল পরিবেশ মানুষের মানসিক সমস্যা ও অপরাধপ্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তর সূত্র বলছে, গত এক বছরে রাজধানীর আটটি ক্রাইম বিভাগের ৫০ থানা এলাকায় হত্যার ঘটনায় ১৬৫টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে অনেক মামলায় সন্দেহে থাকা ব্যক্তি গ্রেপ্তার হয়েছে। বেশির ভাগ মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। ডিএমপির এক পরিসংখ্যান বলছে, পারিবারিক কলহের জেরে খুনের ঘটনা বেড়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৩ মাসে সারা দেশে এক হাজারের বেশি হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব ঘটনার ৬০ শতাংশ পারিবারিক কলহের কারণে ঘটে। নিরপরাধ শিশুরাও স্বামী-স্ত্রীর বিরোধের কারণে হত্যার শিকার হয়।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, গত ১৫ নভেম্বর থেকে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় সামাজিক বিরোধ থেকে সংঘর্ষ, সংঘাত, হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনী সহিংসতার অন্তত ৭৪৯টি ঘটনায় নিহত ১৫ জন। আহত দুই হাজার ৫১৬ জন। ১০০ জনের বেশি গুলিবিদ্ধ হয়েছে। ৪৫০টির বেশি গৃহ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, আগুন ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে দেশে রাজনৈতিক সংঘাতে ৪৫ জন নিহত হয়েছে। এ সময় গণপিটুনিতে ৫১ জন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে ২০ জনের মৃত্যু হয়। গত বছর নারীর প্রতি সহিংসতা ছিল উদ্বেগজনক বিষয়। এ সময়ে সারা দেশে ৫৭৩ জন নারী ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় তিন নারীকে। ধর্ষণের শিকার আরো তিন নারী আত্মহত্যা করেন। এ ছাড়া এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন ১২২ জন পুরুষ। প্রতিবাদ করতে গিয়ে আটজন নারী-পুরুষ খুন হন।
পুলিশের সাবেক আইজি মো. শহীদুল হক বলেন, বর্তমানে সামাজিক অস্থিরতা বেড়েছে। এ কারণে খুনোখুনি বাড়ছে। শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী দিয়ে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এসব রোধে সমাজের বিজ্ঞজন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করেন তিনি।