যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংক অব নিউইয়র্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের গচ্ছিত রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। সেদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি হয় ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। এর মধ্যে ফেরত পাওয়া গেছে মাত্র ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার। ছয় বছরেও ফেরত আসেনি বাকি ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার (বাংলাদেশের অর্থমূল্য ৫৬০ কোটি টাকা)। এ টাকা ফেরত নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে, মিলেনি এই অর্থ ফেরত দেওয়ার কোনো আশ্বাসও।
সুইফট পেমেন্ট পদ্ধতিতে সাইবার হামলা চালিয়ে ফেডারেল ব্যাংক অব নিউইয়র্কে গচ্ছিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা ওইসময় সারাবিশ্বে আলোচনার ঝড় তুলে। দুর্বৃত্তরা মোট ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির প্রয়াস চালালেও বানান বিভ্রাটের কারণে রাউটিং ব্যাংকের সন্দেহ হলে দুর্বৃত্তরা শ্রীলংকামুখী ২ কোটি ডলার হাতিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়। বাকি ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ম্যানিলাভিত্তিক রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন (আরসিবিসি) হয়ে প্রবেশ করে ফিলিপাইনের বিভিন্ন ক্যাসিনোয়।
রিজার্ভ চুরির এ ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংক জানতে পারে একদিন পরেই। কিন্তু অজানা কারণে তা গোপন রাখে আরও ২৪ দিন। আর বিষয়টি তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় চুরি যাওয়ার ৩৩তম দিনে। ঘটনার ৩৯ দিন পর বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে মতিঝিল থানায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি, মানি লন্ডারিং ও সাইবার অপরাধ দমন আইনের ধারায় মামলা করা হয়। পরে ওই মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডিকে।
রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তৎকালীন গভর্নর ড আতিউর রহমানকে পদত্যাগে বাধ্য করা হলেও বাংলাদেশেও কারও বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল সরকার। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, রিজার্ভ চুরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছিল বাংলাদেশ চূড়ান্ত সর্বনাশ ঘটানো হয় আন্তর্জাতিক লেনদেনের নেটওয়ার্ক সুইফট সার্ভারের সঙ্গে স্থানীয় লেনদেনের নেটওয়ার্ক জুড়ে দিয়ে।
রিজার্ভ চুরি এই ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কোর্টে মামলা করে, তবে ওই মামলা টেকেনি। অর্থ ফেরত ও জড়িতদের শাস্তির জন্য স্টেট কোর্টে মামলা হয়েছে। ওই মামলা বিচারাধীন রয়েছে। চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত পাওয়ার আশার আলো কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান কর্মকর্তা মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেন, চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত পাওয়ার আশা থাকলেও কবে নাগাদ পাওয়া যাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট কোর্টে মামলা চলছে। এখন আমাদের আর কিছু করারও নেই। সেখানে আমাদের আইনজীবী নিয়োগ করা আছে, এখন নির্ধারিত সময়ে সময়ে শুনানি হবে। আর আদালত যেহেতু দুরের, সে কারণে আমাদের কিছুই করারও নেই। তার মতে, এখন মামলার মাধ্যমেই বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে। ফলে টাকা উদ্ধারে এখন আদালতের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে।
যদিও শুরুর দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছিল, পুরো অর্থ দুই-তিন বছরের মধ্যে ফেরত আনা সম্ভব হবে। চুরির প্রথম বছর শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনের স্বেচ্ছায় দেওয়া অর্থের বাইরে আর এক টাকাও উদ্ধার হয়নি। ফিলিপাইন থেকে অর্থ ফেরতে কোনও অগ্রগতি না থাকায় এখন যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে বাংলাদেশের মামলা চলছে।
জানা গেছে, রিজার্ভ থেকে চুরির অর্থ ফেরত দেওয়ার জন্য শুরুর দিকে ফিলিপাইন ব্যাপক সহায়তা করছিল। দেশটির বিভিন্ন সংস্থা তখন বাংলাদেশের পক্ষে ১২টি মামলা করে। তবে দেশটির সরকার পরিবর্তনের পর সেই তৎপরতায় ভাটা পড়ে। সমঝোতার মাধ্যমে অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করেও সফল হয়নি। যে কারণে অনেকটা বাধ্য হয়ে তৃতীয় দেশ যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ। প্রথমে ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটন সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে বাংলাদেশের পক্ষে একটি মামলা দায়ের করে নিয়োগকৃত ল’ ফার্ম কোজেন ও’কনর। তবে ২০২০ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের ওই আদালত জানিয়ে দেয়, মামলাটি তাদের কোর্টের এখতিয়ারাধীন নয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২৭ মে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক বা নিউইয়র্ক ফেডে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮১০ কোটি টাকা চুরি হয় ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ফেরত আসে ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এখনো চুরি হওয়া অর্থের ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা ৫৬১ কোটি টাকা উদ্ধার হয়নি।