রাজশাহী প্রতিনিধি:-গত কয়েক বছরের মতো এবারও চালু হচ্ছে কৃষিপণ্যবাহী ‘ম্যাংগো স্পেশাল’ ট্রেন। তবে কবে নাগাদ ট্রেনটি চালু হবে, সেটি এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তবে আশা করা হচ্ছে মে মাসের শেষের দিকে আমের ভরা মৌসুমে এই ট্রেনটি চালু করা হবে। চলবে সপ্তাহ খানেকের মতো। তবে ব্যবসায়ী ও আমচাষিরা বলছেন, ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য এই ট্রেনটির সুবিধা আছে। কিন্তু বড় ব্যবসায়ীদের ট্রেনে আম পরিবহণ করতে গিয়ে উল্টো লোকসান এবং হয়রানির শিকার হতে হয় বেশি।
এ থেকে মুক্তি পেতে বাগান থেকেই রেলওয়ের নিজস্ব পরিবহনে স্টেশন পর্যন্ত আম পরিবহন করবে আবার নিজস্ব পরিবহনে ব্যবসায়ীদের চাহিদামতো বাজারে পৌঁছে দিতে হবে। আর এটি করতে ব্যর্থ হলে বড় ব্যবসায়ীদের জন্য আম পরিবহণ খরচ অর্ধেকে নামাতে হবে। তবেই বড় ব্যবসায়ীরা ট্রেনে আম পরিবহনে আগ্রহী হবেন।
রেলওয়ে সূত্র মতে, গত কয়েক বছর ধরে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আমের মৌসুমে একজোড়া ট্রেন চলাচল করে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী-ঢাকা রুটে এই এক জোড়া ট্রেনটি চলাচল করে সীমিত সময়ের জন্য। যা কৃষি পণ্যবাহী (পার্শ্বেল) হিসেবে চলাচল করে। ট্রেন দুটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর স্টেশন থেকে যাত্রা শরু করে। ১ ও ২ নামের ট্রেন দুটি সপ্তাহে ৭ দিনই এই রুটে আম-সবজিসহ বৈধ পণ্যসামগ্রী নিয়ে যাতায়াত করে। স্টেশনের দূরত্ব ভেদে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। প্রতিকেজি আম পরিবহণের জন্য সর্বনিম্ন ১ টাকা ১০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ১ টাকা ৩০ পয়সা ভাড়া আদায় করে রেল। এবারও একই হারে ভাড়া নির্ধারণ করে ট্রেন দুটি চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তবে এখনো আমের পুরোদমে বেচা-কেনা শুরু না হওয়ায় এবং জাতের আম বাজারে আসার সময় না হওয়ায় ম্যাঙ্গ স্পেশাল ট্রেনটি চালু করতে পারছে না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
জানতে চাইলে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েও মহাব্যবস্থাপক সিম কুমার তালুকদার বলেন, ‘এখনো আমের পুরো মৌসুম শুরু হয়নি। তাই এখন ট্রেন চালু করলে বড় ধরনের লোকসানে পড়তে হবে। আশা করা যাচ্ছে আগামী ২৫ মে’র পরে আমের বেচা-কেনা জোরে-সরে শুরু হবে। তখন আমপরিবহণও বাড়বে। সেই সময়ের দিকে এক সপ্তাহের জন্য ম্যাঙ্গ স্পোশাল ট্রেনটি চালু করা হবে।’
এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহী থেকে একটি ট্রাকে অন্তত ৪৫০ ক্যারেট (প্রতিটি প্লাস্টিকের ক্যারেটে ২২ কেজি করে আম পরিবহণ করা যায়) আম পরিবহণ করা যায়। রাজশাহী-ঢাকা এই এক ট্রাক আম পরিবহণের জন্য ভাড়া আদায় করা হয় ১৬-১৮ হাজার টাকা। সেই হিসেবে ৯ হাজার ৯০০ কেজি পর্যন্ত আম পরিবহণ করতে পারেন ব্যবসায়ীরা। একেবারে বাগান থেকে বা গ্রামের কোনো মোড় বা বাজার থেকে সরাসরি এই ট্রাকে উঠিয়ে একেবারে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে পরিবহণ করা যায়। কিন্তু এক ট্রাক আম ট্রেনে করে পরিবহণ করতে ব্যবসায়ীদের তিন দফায় খরচ হয়।
এর মধ্যে বাগান বা বাজার থেকে প্যাকিং করে স্টেশনে আনতে হয়। এতে গাড়ি ভাড়া ও শ্রমিক খরচ দিতে হয়। এর পর স্টেশনে নামানো উঠানোর জন্য আলাদা খরচ করতে হয়। সেখান থেকে ঢাকায় গিয়ে আবার গাড়িতে উঠানোর জন্য খরচ করতে হয়। এর পর ঢাকার বিভিন্ন বাজারে পৌঁছাতে আলাদা গাড়ি ভাড়া করতে হয়। এতে করে এক ট্রাক আম ট্রেনে পৌছাতে তিন দফায় ট্রেন ভাড়াসহ পরিবহণ খরচ গিয়ে দাঁড়ায় কমপক্ষে ২৫ হাজার টাকা। এর বাইরেও রয়েছে নানা ঝক্কি-ঝামেলা। ঢাকায় ট্রেনটি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সময় নেয় সকাল ৭-৮। তৎক্ষণে আড়তে আম কেনা-বেচা শুরু হয়। কিন্তু ট্রাকে করে সরাসরি আম পরিবহণ করলে ভোর বেলায় আম পৌঁছে যায়।
গতকাল রাজশাহীর বানেশ্বরে বাজারে আম কিনতে আসা ঢাকার পাইকার মাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা কেন ট্রেনে আম দিবো? ট্রেনে আম পরিবহণ করতে তিন দফায় খরচ করতে হবে। তার পরেও সময়মতো আম আড়তে গিয়ে পৌঁছাবে না, কিন্তু ট্রাকে করে আম পাঠালে বাগান বা বাজার থেকেই সরাসরি আড়তে সেটি পৌঁছে যায়। খরচ প্রায় অর্ধেক হয়। তাই কোনো বড় ব্যবসায়ীই চান না ট্রেওেন আম পরিবহণ করতে।’
আরেক ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘ট্রেনের বুকিং দেওয়া থেকে শুরু করে আম স্টেশনে পৌাঁছানো, ঢাকার স্টেশন থেকে আবার আড়তে নিয়ে যাওয়া অনেক ঝামেলা হয়। এসব ঝামেলার হাত থেকে ব্যবসায়ীদের উদ্ধার করতে হলে রেলের নিজস্ব পরিবহণ দিয়ে বড় ব্যবসায়ীদের আম বাগান থেকে বা বাজার থেকে সংগ্রহ করে ঢাকার আড়তে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আর না হলে ভাড়া অর্ধেকে নামাতে হবে। তবেই আমাদের মতো বড় ব্যবসায়ীরা আগ্রহী হবেন ট্রেনে আম পরিবহণে।’
এদিকে দুর্গাপুরের আলথাফ হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমি মোবাইলে আমের ওয়ার্ডার নিই(চাহিদা। সেই আম কুরিয়ারে বা ট্রেনে করে পাঠায়। এতে কুরিয়ারে এক মণ আম পাঠাতে কমপক্ষে ৪০০ টাকা খরচ হয়। কিন্তু ট্রেনে পাঠাতে খরচ হয় মাত্র ১০০ টাকার মতো। আমার মতো যারা অনলাইনে বা মোবাইলের মাধ্যমে আমের ব্যবসা করেন সেসব ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য ট্রেন অনেক সুবিধা লাভজনক। কুরিয়ার কম্পানীগুলো এই সময় আম পরিবহণের নামে ডাকাতি করে। তাই ট্রেন চালু হলে আমাদের অনেক সুবিধা হয়।’
এদিকে রাজশাহী স্টেশন ম্যানেজার আব্দুল করিম জানান, ম্যাঙ্গ স্পেশাল ট্রেনটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর স্টেশন থেকে ঢাকার কমলাপুর স্টেশন পর্যন্ত যাতায়াত করে। রহনপুর স্টেশন থেকে প্রতি কেজি আম পাঠাতে খরচ পড়ে ১ টাকা ৩০ পয়সা। আর রাজশাহী স্টেশন থেকে খরচ পড়ে ১ টাকা ১৭ পয়সা। এই আমগুলো নামানো যায় টাঙ্গাইল, মির্জাপুর, মৌচাক, জয়দেবপুর, টংগী, বিমানবন্দর ও কমলাপুর স্টেশনে। অন্যদিকে রোহনপুর, আমনুরা, সিতলাই, রাজশাহী, সরদহরোড, আড়ানী, আব্দুলপুর স্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ম্যাঙ্গ ট্রেনে আম ওঠানো যায়।