রাজশাহী প্রতিনিধি ;- সরকার প্রণীত “জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা” বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গৃহীত সরকারি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে রাজশাহীতে। জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা বাস্তবায়ন দাবি আদায় কমিটির আয়োজনে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, প্রবীণ ব্যক্তিদের সার্বিক কল্যাণ ও আর্থ-সামাজিক সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৮ সাল হতে বয়স্ক ভাতা প্রদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে। এ ছাড়াও অবসরপ্রাপ্তদের পেনশন ব্যবস্থা সহজীকরণ ও সুবিধাদি বৃদ্ধি করেছে। পরবর্তীতে “মাদ্রিদ আন্তর্জাতিক কর্মপরিকল্পনার” প্রতি বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয় সমর্থন ব্যক্ত করে প্রবীণদের সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের বিষয়টি মাথায় রেখে ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর মন্ত্রীসভায় “জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা” অনুমোদন দেয়। পরের বছর ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ বাংলাদেশের ষাট বছর বা তদুর্ধ বয়সী নাগরিকদের ‘সিনিয়র সিটিজেন’ (জ্যেষ্ঠ নাগরিক) হিসেবে ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে ২০১৫ সালের ৪ জুন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে চূড়ান্ত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। তারা কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিভাগকে একাধিকবার চিঠি দেয়। কিন্তু তাদের অনেকের কাছ থেকে কোনো আশাব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া যায়নি বলে আমরা বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পারি। অগ্রগতির কোন খবরও আমাদের জানা নেই।
লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, এরপর সুদীর্ঘ ৮টি বছর অতিক্রান্ত হতে চললো, কিন্তু বাস্তবায়নের কোনো সংবাদ আমরা জানতে পারছি না। অজ্ঞাত কারণে মন্ত্রণালয় কিংবা বিভাগের কোন কার্যক্রমই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এই নীরবতায় আমরা গভীরভাগে হতাশ এবং উদ্বিগ্ন। এতে সরকারের প্রতি জনগণের ভরসার জায়গাটিও দুর্বল হচ্ছে। সরকারের আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ ৮ বছর ধরে বাস্তবায়নের বিষয়টি কারা ঝুলিয়ে রেখে প্রবীণদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে এবং তাদের প্রতি চরম অন্যায় ও অবহেলা করছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, জনশুমারী ও গৃহগণনা ২০২২-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ৬০ বছরের বেশী বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার ৭১৯ জন। তারা মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০১১ সালের জনতমারিতে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। গত ১১ বছরের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বৃদ্ধির হার দেশের ধারাবাহিক জনতমারির ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি। এই বৃদ্ধির হার অব্যাহত থাকলে প্রবীণরা রাষ্ট্রের জন্য এক সময় বোঝা হয়ে উঠবে।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, আমরা জানি, ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে জাতীয় জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটি অনুধাবন করেই অঙ্গীকার করা হয়েছিল যে, প্রবীণদের জন্য সম্ভাব্য ক্ষেত্রে আয় সৃষ্টিকারী কার্যক্রম গ্রহণ, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে পাঠ্যবইয়ে প্রবীণদের বিষয়ে আলাদা অধ্যায় সংযোজন, যানবাহন এবং আবাসিক স্থাপনাগুলোতে তাঁদের জন্য আসন / পরিসর নির্ধারণ, বিমানবন্দর, বিভিন্ন স্থাপনা ও যানবাহনে ওঠা নামার ব্যবস্থা প্রবীণবান্ধব করে গড়ে তোলা হবে।” এই অঙ্গীকারের প্রতি সদয় বিবেচনার্থে আমাদের মাথার ছাতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, সরকারের দিক থেকে যা করার, সেটার জন্য মাঠ প্রস্তুত করেই রাখা হয়েছে, এখন শুধু যারা ‘কর্মপরিকল্পনা’ বাস্তবায়নে কাজ করবেন, তাঁদের আন্তরিকতা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন, প্রবীণ নীতিমালা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট যেসব মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ ও শাখাগুলো কাজ করবেন তাদের অনীহা কেন? তারাও তো একদিন প্রবীণ হবেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, প্রবীণদের অধিকার রয়েছে সম্পূর্ণ মর্যাদাপূর্ণ জীবন-যাপনের। মানবজীবনে বার্ধক্য বা প্রবীণত্ব হচ্ছে সবচেয়ে নাজুক ও স্পর্শকাতর অবস্থা। তাঁরা প্রতিমুহুর্তে সামাজিক, মানসিক, আর্থিক, আইনি ও শারীরিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। সামাজিক নিরাপত্তা অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। পরিবার, দেশ ও দশের স্বার্থে এক সময় যারা। জীবনকে উৎসর্গ করেছেন, বার্ধক্যের সময় যথাযথ মর্যাদা তাদের প্রাপ্য। আজকের সমাজ ও সভ্যতার কারিগর মূলত প্রবীণরাই। অথচ সামাজিক এই অবদানের স্বীকৃতি পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেও উপেক্ষা করা হচ্ছে। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ধারায় দেখা যাচ্ছে, প্রবীণরা প্রথমত নিজ পরিবারেই তাদের ক্ষমতা ও সম্মান হারাচ্ছেন এবং ধীরে ধীরে সমাজের সকল কর্মকান্ড হতে বাদ পড়ছেন। বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের প্রবীণদের বার্ধক্যজনিত সমস্যা, অন্যদিকে চরম আর্থিক দীনতার মধ্যে থাকার কারণে তারা পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সকল ধরনের সেবা পাবার সুযোগ হতে বঞ্চিত। ফলে প্রবীণ জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছেন, যা দ্রুত জাতীয় সমস্যার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে প্রবীণদের উন্নয়নের বিষয়টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এখন বেশ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর রেশ ধরেই দীর্ঘমেয়াদী ও স্থায়ী কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে দেশের প্রবীণদের অধিকার সমুন্নত রাখা এবং তাঁদের আর্থ-সামাজিক সম্মান ও সার্বিক কল্যাণ সাধণের উদ্দেশ্যে জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা, ২০১৩’ অনুমোদন দেন এবং পরবর্তীতে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এখন শুধু বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। পরিশেষে আমরা বলতে চাই, “জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা” বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, তা যেন আর কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ না থাকে।
লিখিত বক্তেব্যে আরও বলা হয়, প্রবীণদের নীতিমালাটি যেন নীতিমালার মালা না হয়ে কাজে রূপ পায়। মহামান্য রাষ্ট্রপতিও একজন প্রবীণ এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও প্রবীণা। তাঁরা প্রবীণদের দুঃখ-কষ্ট হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেন। আশা করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রবীণবান্ধব হয়ে বিষয়টি বিবেচনা করবেন। তাই আমাদের দাবি, সরকারের জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়নের লক্ষে সরকারি কর্মপরিকল্পনাটি দ্রুত বাস্তবায়ন করে প্রবীণদের মর্যাদ বৃদ্ধি কেরতে হবে।