জেলা প্রতিনিধি, পাবনা:
দুপুর ২টা ১০ মিনিট, স্কুলের একমাত্র ভবন তালাবদ্ধ। আশপাশে কারো দেখা নেই, কিন্তু তালাবদ্ধ ভবনের রুমগুলোতে চলছে ফ্যান। ভবনের ক্যাচিগেটের পাশে বারান্দার ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া জাতীয় পতাকা। ভবনের পাশেই ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনারটিও ভেঙে পড়ে আছে। রুমের জানালাতে ঝুলছে পাট।
এচিত্র পাবনার বেড়া উপজেলার ঢালারচর ইউনিয়নের চর দুর্গাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর) দুপুর ২টার দিকে সরেজমিন পরিদর্শন করে এচিত্র পাওয়া গেছে।
সাংবাদিকদের উপস্থিতি দেখে এগিয়ে আসেন এলাকাবাসী ও স্থানীয় কয়েকজন শিক্ষার্থী। তারা বলেন, ‘১০-১১টার দিকে স্কুলে আসেন শিক্ষকরা। ১-২ ঘণ্টার মধ্যে দুই-তিনটা ক্লাস নিয়েই স্কুল ছুটি দিয়ে দেন শিক্ষকরা। ঠিক মতো স্কুলটা বন্ধও করে না। ফ্যান-লাইট রাতদিন ২৪ ঘণ্টা অটো চলে। মাঝে মাঝে পতাকাতো মাঠের মধ্যে গড়াগড়ি করে। এসব কেউ দেখার নেই। কেউ এখানে আসে না। তারা প্রতিবাদ করলে শিক্ষকরা বলেন- ‘আপনারা বেশি বেশি করে অভিযোগ করেন যাতে এখান থেকে আমাদের বদলি করে দেয়।’
শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা স্যারদের বলার পরও তারা ঠিক মতো পড়ালেখা করান না। আমরা বিদ্যালয়ে এসে এক-দুইটা ক্লাস করে একটু খেলাধুলা করেই চলে যাই। মাঝেমধ্যে আবার কোনও শিক্ষকই আসেন না, আমরা স্কুলে এসে বাড়িতে ফিরে যাই। মাঝেমধ্যে স্কুলের চাবি আমাদের কাছে দিয়ে বলে- ‘তোরাই স্কুল খুলবি, আর বন্ধ করবি।’ স্কুলে বাথরুম থাকলেও আমাদের ব্যবহার করতে দেয়া হয় না। শুধু স্যাররা ব্যবহার করেন।’
খবর পেয়ে বিদ্যালয়ে ফিরে আসেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক শফিউল আলম সোহেল এবং তার বোন সহকারী শিক্ষক তাসলিমা শিকদার। তড়িঘড়ি করে বারান্দা থেকে তুলে দণ্ডে ঝুলিয়ে দিলেন জাতীয় পতাকা। বিদ্যালয়ের এমন পরিস্থিতির কথা শুনে কিছুক্ষণ পরেই এসে হাজির হলেন বেড়া উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম। তার উপস্থিতিতেই স্কুলের এমন করুণ অবস্থার কথা স্বীকার করতে বাধ্য হোন প্রধান শিক্ষক।
তিনি বলেন, ‘স্কুলের পিওন নিয়মিত আসেন না। তাই জাতীয় পতাকা নিয়ে এমনটা হয়েছে। আর স্কুল নিয়মিতই চলে। আমাদের বাসা একটু দূরে এবং একটু অসুস্থ তাই আজকে আমরা তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিলাম। আমাদের এখানে শিক্ষকতা করতে অসুবিধা হয়, উপজেলা শিক্ষা অফিসে অনেকবার বলেছি যে, আমাদের বদলি করে দেন, কিন্তু তারা দেন না।’
স্কুলের দোতলা ও তিনতলায় রুম রয়েছে ৬টি। একটি শিক্ষকরা ব্যবহার করেন, বাকিগুলো শিক্ষার্থীরা। এসব রুমে বসার মতো পর্যাপ্ত ব্রেঞ্চ-চেয়ার কিছুই নেই। বিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও স্লিপের টাকার বিষয়ে কোনও সদোত্তর দিতে পারেননি স্কুলের প্রধান শিক্ষক শফিউল আলম সোহেল।
এসময় উপস্থিত সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘নিয়মের বাহিরে নিজের ইচ্ছায় বদলি চাওয়ার সুযোগ নেই। আর পরিস্থিতি যেহেতু নিজের চোখে দেখলাম। আমি সেই ভাবেই রিপোর্ট করবো এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় সকল ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
ভাঙা ও জরাজীর্ণ শহীদ মিনার পুনর্নিমাণের জন্য খুব শিগগিরই ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানালেও বিদ্যালয় পরিদর্শন না করার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
এবিষয়ে বেড়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা কফিল উদ্দিন বলেন, ‘সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ও আপনাদের (সাংবাদিক) মাধ্যমে বিষয়টি জানলাম এবং সত্যতা পেয়েছি। জাতীয় পতাকা অবমাননাসহ বিদ্যালয়ের এমন পরিস্থিতি মেনে নেয়া যায় না। তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছি। তাদের প্রথমে শোকজ করা হবে, তাতে সন্তোষজনক বক্তব্য পাওয়া না গেলে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।