নম্বরের খাঁচায় ভবিষ্যৎ আমরা কী মানুষ নাকি এ প্লাস?
একজন মেয়ে ঘুমহীন চোখে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
পাশের ঘর থেকে শোনা যাচ্ছে—”পরীক্ষায় গোল্ডেন না পেলে মেডিক্যালে সুযোগ নাই, বুঝলি?”
দেয়ালের ওপাশে আরেকজন ছেলে সিটিয়ে বসে আছে—প্রশ্ন ফাঁস হবে কি না, তারই চিন্তায় ঘামছে কপাল।
পৃথিবীর কোনো স্কুল কি শেখায়, কীভাবে এই বয়সে এমন ভয় নিয়ে বাঁচতে হয়?
আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার বদলে আজকের ছাত্রজীবন যেন এক সাপ লুডুর খেলা—প্রথম ঘরে “কোচিং”, মাঝখানে “প্রশ্নব্যাংক”, শেষে “জিপিএ-৫”।
তুমি কেমন মানুষ? তুমি কতটা চিন্তাশীল? তুমি কী সৃষ্টি করো?—এসব প্রশ্নের মূল্য নেই, যদি তুমি নম্বরের দৌড়ে টিকে না থাকো ।
“তুই এবার GPA-5 না পেলে…”
এই অসমাপ্ত বাক্যটাই শেষ করে দেয় একজন কিশোরের অনেক অনিশ্চিত স্বপ্ন।
বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ২০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে (সূত্র: বাংলাদেশ শিক্ষা বোর্ড, ২০২৪)।
এর মধ্যে প্রায় ৬০% শিক্ষার্থী কোনো না কোনো সময় মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভোগে (সূত্র: ব্র্যাক শিক্ষা বিভাগ, ২০২৩)।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “এটি শুধু পরীক্ষার চাপ নয়, এটি এক ধরনের সমাজসৃষ্ট আতঙ্ক।”
পরীক্ষার আগে কেবল একটি কথাই আমরা শুনি—“ভালো রেজাল্ট না করলে, জীবনে কিছুই হবে না।”
কিন্তু আমরা কি কখনো শুনেছি—“ভালো মানুষ না হলে, সমাজে কিছুই হবে না?”
কোচিং বনাম আত্মবিশ্বাস:
এক অসম লড়াই
ঢাকার অভিজাত এলাকায় করা এক জরিপে দেখা গেছে, একজন এইচএসসি শিক্ষার্থীর প্রতি মাসে গড় কোচিং খরচ ৫,০০০ থেকে ১৫,০০০ টাকা পর্যন্ত।
তবু সেই শিক্ষার্থী বলে—“আমি তো কিছুই বুঝি না, শুধু মুখস্থ করি।”
স্কুল হয়ে উঠেছে শুধুই নম্বরের প্ল্যাটফর্ম, আর কোচিং সেন্টার হয়ে উঠেছে পরীক্ষার টিকিট বিক্রির হাট।
আত্মবিশ্বাস জন্মায় না বইয়ের প্রশ্নফাঁসে, আত্মবিশ্বাস আসে শেখার আনন্দে। কিন্তু সে আনন্দ আজ কোথায়?
মুখস্থ না বুঝে পড়া:
জিপিএ-এর জালে আটকানো মেধা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আমরা যখন দেখি, “A+ পাওয়া অনেকেই মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না”—তখন বুঝি, মুখস্থ করে অর্জিত নম্বর আর সত্যিকারের জ্ঞান এক নয়।
একটি গবেষণায় দেখা যায়, ৯২% শিক্ষার্থী ক্লাস এইট থেকে মুখস্থ পদ্ধতিতে পড়াশোনায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে (সূত্র: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ২০২২)।
তারা জানে কীভাবে লিখতে হয়, কিন্তু জানে না কেন লিখছে।
নম্বর নয়, প্রয়োজন দক্ষতা ও মূল্যবোধ
জাতিসংঘ বলেছে, ২১ শতকের দক্ষ শিক্ষার্থী হতে হলে চাই ‘4Cs’—Critical thinking, Creativity, Collaboration, Communication।
কিন্তু আমাদের বোর্ড সিলেবাসে কোথাও সৃজনশীল চিন্তা, মানবিক গুণ বা সামাজিক মূল্যবোধ শেখানোর নির্দিষ্ট ধারা নেই।
নম্বর আছে, কিন্তু নেই মানবতা।
রেজাল্ট আছে, কিন্তু নেই সহমর্মিতা।
কে গড়বে ভবিষ্যৎ?:
একদিন, হয়তো সেই ছেলেটি GPA-৫ পেয়ে ডাক্তার হবে।
কিন্তু যদি সে মানুষের চোখের জল না বুঝতে শেখে, সে কেমন ডাক্তার হবে?
অন্যদিকে, হয়তো কেউ GPA-৩ পেয়েও হয়ে উঠবে সমাজের বাতিঘর—যেমন কিছু সত্যিকারের শিক্ষক, উদ্যোক্তা কিংবা শিল্পী।
আমরা কি এমন একটা সমাজ চাই, যেখানে নম্বর দিয়েই মাপা হবে জীবনের সবকিছু?
না, ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে প্রশ্নচিহ্ন দিয়ে, চিন্তাভাবনা দিয়ে আত্মবিশ্বাস দিয়ে নয় কেবল নম্বর দিয়ে।
আজ দরকার একটি নতুন প্রশ্ন:
“তুমি কত নম্বর পেয়েছো?” নয়, বরং—
“তুমি কে হতে চাও?”
লেখকঃ শেখ মাহদী ইসলাম
দ্বাদশ শ্রেণী
সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ