রাজশাহী : অবাধে পুকুর খননের কারনে ঔষধি গ্রাম খ্যাত নাটোরের লক্ষ্মিপুর খোলাবাড়িয়া গ্রামের আবাদি জমির পরিমান কমতে শুরু করায় শংকিত হয়ে পড়েছেন ভেষজ চাষীরা।
স্থানীয়দের দাবী,জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে পচে যাচ্ছে এ্যালোভেরা সহ ভেষজ উদ্ভিদ। গত ২/৩ বছরে পুকুর খনন করায় এই ঔষধি গ্রামের প্রায় ৫০ হেক্টর জমি কমে গেছে । তবে কৃষি বিভাগ বলছে ঔষধি গ্রামে জমি কমেছে ২৫ হেক্টর। পুকুর খননের দৌরত্ব সহ উৎপাদিত পণ্যের বাজার মুল্য না পাওয়ায় দিশেহারা এলাকার চাষীরা।
শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দুরে নাটোর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর খোলাবড়িয়া ইউনিয়নের ১৭টি গ্রামের ১৪০ হেক্টর জমিতে এ্যলোভেরা সহ প্রায় শতাধিক প্রজাতির ভেষজ পণ্য উৎপাদিত হয়। এছাড়া নার্সারি করে আরো প্রায় ৫শতাধিক রকমের ভেষজ চারা তৈরি করা হয়। কিন্তু গত ২ থেকে ৩ বছর ধরে অবাধে পুকুর খননের কারনে ঔষধি গ্রামখ্যাত এই লক্ষিপুর খোলাবাড়িয়ায় আবাদি জমির পরিমান কমতে শুরু করেছে। পুকুর খননের কারনে পানি নিক্সাসন পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় উৎপাদিত ভেষজ নষ্ট হচ্ছে।
এছাড়া এসব উৎপাদিত ভেষজ পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না চাষীরা। সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রী এলাকা পরিদর্শনে আসেন এবং এই ঔষধি গ্রামের প্রশংসা করেন। একই সাথে চাষীদের জন্য বেশ কিছু পরিকল্পনার কথা বললে চাষীরা খুশী হয়েছিলেন। কিন্তু পুকুর খনন তাদের গলার কাটা হওয়ায় তারা শংকিত হয়ে পড়েছেন।
লক্ষিপুর খোলাবাড়িয়া গ্রামের ভেষজ চাষী ও নার্সারি মালিক জয়নাল আবেদীন বলেন,তিনি ২০০১ ও ২০০২ সাল থেকে এলাভেরা সহ ভেষজ চাষ শুরু করেন। তিনি বর্তমানে নার্সারি করে প্রায় ৫৮০ জাতের ভেষজ চারা তৈরি করছেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসব চারা সংগ্রহ করেছেন। তার নার্সারি থেকে এখন দেশের প্রায় সব অঞ্চলের মানুষ এসে চারা নিয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এই ঔষদি গ্রাম পরিদর্শনে আসেন। মন্ত্রী তার ঔষধি বাগান সহ গ্রামের বিভিন্ন কৃষকের ভেষজ জমি পরিদর্শন করে বিমোহিত হয়েছেন। বিশেষ করে বিপুল পরিমান জমিতে এ্যালোভেরার উৎপাদন দেখে খুশী হয়। এসময় তিনি কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ভেষজ পণ্যের বাজার মুল্য না পাওয়া সহ বিভিন্ন সমস্যার কথ শোনেন।
পরবর্তীতে আমিরগঞ্জ ঈদগাহ মাঠে আয়োজিত কৃষক সমাবেশে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ভেষজ পণ্যের বাজার সৃষ্টি সহ পণ্যের প্রক্রিয়াকরনের প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দেন। এতে ঔষধি গ্রামের কৃষকরা খুশী হন। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে অবাধে পুকুর খননের কারনে ভেষজ চাষ করা নিয়ে আমরা এখন শংকিত। ফসলি জমি কেটে পুকুর খনন করে মাটি নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন ইট ভাটায় । এতে করে এলাকার রাস্তাও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। পুকুর কাটায় দিনে দিনে জমি কমছে এবং পানি নিস্কাসনের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু জমির পানি বের হতে না পেরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করছে। ইতি মধ্যে বেশ কিছু জমি পতিত হয়ে গেছে।
লক্ষিপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়ের আমিরগঞ্জ এলাকার ভেষজ চাষী মজিবুর রহমান বলেন,পানি নিস্কাসনের কোন পথ না রেখেই এসব পুকুর খনন করা হচ্ছে। বষায় জমে থাকা পানি বের হতে না পেরে এ্যালোভেরা পচে যাচ্ছে। গত ২ বছর থেকে এই ঔষধি গ্রামে পুকুর খনন শুরু হওয়ার এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। করোনায় ক্রেতার দেখা পাওয়া যায়নি। এখন জলাবদ্ধার জন্য উৎপাদিত পন্য পচন ধরায় ক্রেতা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। অনেকেই এখন অর্থ কষ্টে রয়েছেন। যারা প্রতি বছর কোরবানীর সময় একাধিক পশু কোরবানী দিয়েছেন তারা এবার একটি পশু কোরবানী দিতে পারছেননা।
ভেষজ চাষী ইউনুস আলী বলেন,তিনি যে সব জমিতে এ্যালোভেরা ও অর্শ্বগন্ধা চাষ করতেন,সে সব জমির চারিদিকে পুকুর খনন করায় এখন চাষাবাদ করতে সমস্যা হচ্ছে। গত দু’বছর ধরে জলাবদ্ধতার কারনে তার প্রায় তিন বিঘা জমি পতিত হয়ে পড়ে রয়েছে। আগের মত পানি নিস্কাসনের ব্যবস্থা করা গেলে পতিত হয়ে পড়া জমিতে আবার ভেষজ সহ অন্য ফসল চাষ করতে পারবেন।
এই ঔষধি গ্রামের ভেষজ চাষীদের অভিযোগ,স্থানীয় প্রশাসনের কাছে থেকে জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে পুকুর খননের অনুমতি নিয়ে আসছে অর্থলোভী একটি চক্র। তিন ফসলি জমিও পুকুর খননের অনুমতি দেয়া হচ্ছে। ফসলি জমির শ্রেণী বিন্যাস করে উপজেলা ভুমি কর্মকতার দেওয়া প্রতিবেদনের পর পুকুর খননের মহোৎসব শুরু হয়েছে।
ভেষজ ব্যবসায়ী ও চাষী বায়োজিত হোসেন জানান,একজনের নামে অনুমোদন এনে একাধিক পুকুর খনন করা হচ্ছে। প্রশাসনিকভাবে মাঝে মধ্যে বন্ধ করা হলেও পরে অদৃশ্য কারনে তা পুনরায় চালু হয়। ইতিমধ্যে প্রায় ৫০ হেক্টর জমি পুকুর খনন করা হয়েছে। এখনও খনন চলছে।
জাকির হোসেন নামে অপর এক চাষী ও ভেষজ ব্যবসায়ী বলেন,যেভাবে পুকুর খনন শুরু হয়েছে তাতে গোটা ঔষধি গ্রাম অস্তিত্ব হারাবে। ইতিমধ্যে প্রায় ১০০ বিঘা জমি পুকুর হয়েছে। এখনও পুকুর খনন চলছে। খননকৃত পুকুরের পাশের জমির পানি বের হতে না পেরে জলাবদ্ধার সৃষ্টি হওয়ায় আবাদ করা যাচ্ছেনা। এসব পুকুর খনন বন্ধ করে ঔষধি গ্রামের পুর্বের পরিবেশ ফিরে আনার দাবি জানান তিনি।
খোলাবাড়িয়া গ্রামের নজরুল ইসলাম জানান, তার প্রায় ২ একর জমিতে ফসল আবাদ না হওয়ায় তিনি প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে পুকুর খনন করেছেন। তিনি পুকুর খনন করায় কোন কৃষকের ক্ষতি হয়নি বা পুকুরের চারিদিকে আবাদি কোন জমি নেই। অধিকাংশ জমি খনন করে মাছ চাষ করা হয়েছে।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান কালু জানান, তার ঔষধি গ্রামখ্যাত খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নে পুকুর খননের মহোৎসব চলছে। তিন ফসলি জমি কেটে পুকুর খনন করা হচ্ছে। অন্য জমির পানি নিস্কাসনের ব্যবস্থা না রেখে এসব পুকুর খনন করায় এসব পুকুরের আশে পাশের অনেক জমি জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এতে করে ওই সব জমিতে আর কোন ফসল আবাদ বা ভেষজ গাছ লাগানো যাচ্ছেনা।
এসব জমির বেশীর ভাগ পতিত হয়ে যাচ্ছে। ফসলি জমিতে খনন করা এসব পুকুর শ্রেণী পরিবর্তন করা হয়নি। পুকুর খননকারী তাদের এসব জমি শ্রেণী পরিবর্তন করেছেন প্রচারনা চালালেও স্বপক্ষে কোন কাগজ দেখাতে পারেনি। তবে কখনও ইউএনও,এসিল্যান্ড সহ ভুমি কর্মকর্তাদের এলাকা পরিদর্শন করতে দেখা গেছে। তিন ফসলি জমিতে পুকুর খনন বন্ধ করতে গ্রাম পুলিশ পাঠিয়েও বন্ধ করা যায়নি।
স্থানীয় প্রশসনের কাছে অভিযোগ করার পর এসব খনন কাজ বন্ধ করা হলেও রাতারাতি খনন করা হয়েছ্। ইতিমধ্যে প্রায় ৫০/৬০ হেক্টর জমি কেটে পুকুর করা হয়েছে যেভাবে পুকুর কাটা হয়েছে বা হচ্ছে তাতে করে ঔষধি গ্রাম হিসেবে পরিচিত পাওয়া লক্ষ্মিপুর খোলাবাড়িয়া অস্তিত্ব হারাবে বলে মনে করছেন তিনি।
নাটোর সদর উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ মেহেদুল ইসলাম পুকুর খননের সত্যতা স্বীকার করে করে জানান, গত তিন বছরে ঔষধি গ্রাম লক্ষিপুর খোলাবাড়িয়া এলাকার ২৫ হেক্টরসহ সদর উপজেলায় ১১৬ হেক্টর জমি পুকুর খনন করা হয়েছে। এখনই এই পুকুর খনন বন্ধ না হলে ভেষজ চাষীদের শংকা সত্যি হতে পারে।
জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, পুকুর খননের পাশাপাশি বাজার মুল্য না পাওয়ায় ঔষধি গ্রামে জমি বা চাষ কমে যাচ্ছে বলে মনে করছেন। তবে যখনই পুকুর খননের খবর পাওয়া যায় তখনই তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে ভেষজ চাষীদের কেউ কেউ এই পুকুর খননের সাথে যুক্ত থাকার পর তিনি নিজেই পুকুর খনন নিয়ে লাগামহীন বক্তব্য দিচ্ছেন। যা সঠিক নয়। ঔষধি গ্রামের চাষীদের জন্য যা যা করার প্রয়োজন তা করা হবে। একই সাথে যারা পুকুর কাটার সাথে যুক্ত হয়ে লাগামহীন বক্তব্য দিচ্ছেন তাদেরও সনাক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে বলে তিনি বলেন।